হাওরে ভাড়ায় ধান রোপন ও কর্তন যন্ত্র

[ড নিয়াজ পাশা]
Combine Harvesterহাওরের সুবিশাল বিস্তৃত, দিগন্ত জোড়া যে গো-চারণ ভূমিতে, আমরা রাখাল বালকের সাথে পালে হাজার হাজার গরু চড়িয়েছি, ডাংগুলি খেলেছি, গো-বাছুরের জন্য ‘চাইল্লা ঘাস’ কেটেছি; সেচ-পানি ও কর্ষন যন্ত্রের অভাবে বছরের পর বছর ধরে সে হাওর পতিত বা অনাবাদি থাকতো,  সেখানে এখন সবুজ ধানের সমারোহ।  সোনালী ধানের ঝিলিকে কৃষকের মুখে হাসি ছড়িয়ে পরছে সর্বত্র । আজ সে মাঠে গরু চড়ানো সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ । স্বাধীনতাত্তোর সময়ে বঙ্গবন্ধুর উদ্যোগে বিশেষ বিমানে করে জার্মানী হতে  হাজার হাজার পাম্প (LLP Pump) এনে হাওরে নাম মাত্র ভাড়ায় বিতরণ করা হয় । বিএডিসি’র উদ্যোগে এ সব সেচ পাম্প, কর্ষন যন্ত্র, উফশী বীজ, সার ও বিনামূল্যে কীটনাশকের বিতরণের ফলেই বিবর্ণ হাওর আজ ধনে ধানে, সজলা, সুফলায় পরিপূর্ণ । বঙ্গবন্ধুর  ‘সবুজ বিপ্লর’র ডাকে  ‘এক ইঞ্চি জমিও পতিত রাখা যাবে না’  বঙ্গবন্ধুর এ আহবানের সফল বাস্তবায়ন হয়েছে হাওরে ।
সারা দেশে ফসলের উৎপাদন (Production) বেড়েছে তিন গুণ । আর হাওরে প্রডাক্টিভিটি (Productivity) যেমন বেড়েছে অনেক। তেমনি ভলিউম অব প্রডাকশান (Volume of production)  বেড়েছে ছ’ গুণেরও বেশী । বঙ্গবন্ধু বুঝেছিলেন, অফুরন্ত সম্ভাবনাময়, উর্বর এবং বিশাল হাওরের পতিত জমিকে দ্রুত চাষাধীনের এনে উতপাদন বৃদ্ধির মাধ্যমে খাদ্য ঘাটতির মোকাবেলা করা  সম্ভব । তিনি এও বুঝেছিলেন যে, গরীব ও অসহায় হাওরের কৃষকদের পক্ষ্যে এ সব দামী সেচ পাম্প  নগদ টাকায় কেনার মত সামর্থ তাদের নাই। তাইতো, তিনি প্রায় বিনামূল্যে, নাম মাত্র ভাড়ায় প্রয়োজনীয় সেচ পাম্প, যাবতীয় খুচরা যন্ত্রাংশসহ সেবা প্রদাণের ব্যবস্থা করেছিলেন । আর এ ব্যবস্থার ফলেই হাওর বিশাল পতিত জমি চাষাধীনে আসে, কৃষকের গোলা সোনালী ধানে ভরে উঠে, ছনের ঘরের জায়গায় রুপালী টিনের ঝলকানি দেখেছি, অনেক কৃষকই  সে সময়  ‘লাখপতি’ বনে গিয়েছিলেন।  এ বিনিয়োগের রিটার্ণ বা  ধারাবাহিকতায় আজ দেশের এক পঞ্চমাংশ ধান হাওরে উতপাদিত হচ্ছে । সারা দেশের মানুষের খাদ্যের যোগান দিচ্ছে হাওর কৃষক ।আজ ও আগামী দিনের খাদ্য ভান্ডারে পরিণত হয়েছে আমার হাওর এলাকা ।
সময়ের বিবর্তনে অবস্থার পরিবর্তন হয়েছে অনেক । অধিক উতপাদন ব্যয়, ফসলের কম দামে বর্তমানে কৃষকের অবস্থা নাকাল । ধান চাষে কৃষক আগ্রহ হারিয়ে ফেলার উপক্রম । হাজার হাজার শ্রমিক দেশের বিভিন্ন প্রান্ত হতে হাওরে ধান রোপন, পরিচর্যা ও কর্তনের জন্য আসতো । কিন্ত বর্তমানে সর্বত্রই কর্মসংস্থান সৃষ্টি হওয়ায় সেভাবে হাওরে শ্রমিক পাওয়া যাচ্ছে না । এ অবস্থায় ধানের উৎপাদনশীলতা (Productivity) এবং মোট উৎপাদন ( Production) কমে যাবার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে । ভয়াবহ শংকা, আতংকে এবং অনন্যোপায় হয়েই তারা ধান চাষ করে । মান্ধাতার আমলের কৃষি পদ্ধতি দিয়ে ক্রমবর্ধমান উতপাদন ব্যয় এবং পরিবেশ, প্রতিবেশ পরিবর্তনের কারণে কৃষকের অস্থিত্ব বিলীণ হবার উপক্রম । জলবায়ু জনিত পরিবর্তনেও হাওরের কৃষি এখন অনেক জটিল ও ঝুকি পূর্ণ । প্রতি নিয়ত তাদের আগাম বন্যা, খরা, শিলা বৃষ্টি ও রোগবালাই এর মূখোমূখি হতে হয় । এক মুহূর্তের বিলম্বে ঘটে যেতে পারে ভয়াবহ ক্ষতি; তলিয়ে যেতে পারে পাকা ফসল । কৃষকের চোখের লোনা জল আর বানের গোলা জল একাকার হয়ে যায় । বন্যা হতে ফসল রক্ষায় আগাম বীজ তলা করলে ধান চিটা হয় । আবার দেরীতে বপন করলে বন্যায় ডুবে যায়। শাখের করাতের নীচে হাওরের ফসল; এ যেন বেচে থাকার জন্য মৃত্যুর দিকে ধাবিত হওয়া’ সম । শ্রমিকেরও প্রচন্ড অভাব । সঠিক সময়ে কৃষি কার্যাদি সম্পাদনের মাধ্যমে এ সব আপদ-বালাই হতে ফসল  রক্ষার জন্য কৃষি যান্ত্রিকীকরণ ছাড়া আর কোন বিকল্প নাই । কৃষি যান্ত্রকীকরণ ব্যতিত প্রতিযোগিতা মূলক উতপাদন বাস্থবতায় ঠিকে থাকাই দায় হবে । সরকার কৃষি  ক্ষেত্রে বিভিন্ন রকম প্রণোদনা দিচ্ছে । উতপাদন বৃদ্ধি, উতপাদন খরচ হ্রাস, কর্তনোত্তর ক্ষতি কমানো, ফসলের মান ও গুণ বজায় রাখা ও ফসলের নিবিড়তা বাড়াতে কায়িক শ্রম নির্ভরতা কমিয়ে যন্ত্র ও প্রযুক্তি নির্ভরতা বাড়াতে হবে । এ অতিরিক্ত শ্রম শক্তি আমরা অন্য ক্ষেত্রে নিয়োজিত করতে পারবো ।
এ উপলব্দি থেকে বর্তমান সরকার কৃষি যান্ত্রিকীকরণের উপর  অনেক গুরুত্ব দিয়েছে । ব্যক্তি ক্ষতি বা কম উৎপাদনে জাতীয় খাদ্য নিরাপত্তায় বড় রকমের প্রভাব ফেলবে । তাই, সরকার বিভিন্ন রকম প্রণোদনা দিচ্ছে । প্রথম দফায় যন্ত্রের মূল্যের উপর  ২৫% হারে ভর্তুকি বাবদ প্রায় ১৬০ কোটি টাকা ব্যয় করা হয়েছে । ‘খামার যান্ত্রিকীকরণের মাধ্যমে ফসল উৎপাদন বৃদ্ধি-২য় দফা প্রকল্পের আওতায়’ বরাদ্দ দেয়া হয়েছে ১৭২ কোটি ১৯ লক্ষ ২৫ হাজার টাকা । বাস্তবায়ন কাল ২০১৩-১৮ সাল । এ প্রকল্পের পরিচালক কৃষি প্রকৌশলী নাজিম উদ্দিন শেখ জানান, এ প্রকল্পের  আওতায় ২৫% হারে ২৫ হাজার পাওয়ার টিলার, ৫ হাজার পাওয়ার থ্রেসার,  ৭০০ টি কম্বাইনড হার্ভেস্টার (বড় ১০০, মাঝারী ৬০০), রাইস ট্রান্সপ্লান্টার  ২০০ টি  এবং ১,০০০ টি ফুট পাম্পের উপর ভর্তুকি প্রদাণ করা হবে । এর সাথে থাকবে পর্যাপ্ত পরিমানে প্রদর্শণী প্লট  ও মাঠ দিবসের (১২৫+১৩,০২০টি) আয়োজন । রাইস ট্রান্সপ্লান্টার ব্যবহার করতে ট্রে’তে বিশেষভাবে তেরী উৎপাদিত ধানের চারা লাগবে । আবার কম্বাইনড হার্ভেস্টারে ধান কাটার সুবিধার জন্য রাস্তার পাশের জমি আগে রোপন করে ভিতরে যেতে হবে। সে লক্ষ্যে প্রশিক্ষণ ও কর্মশালার আয়োজন (৩৯৮টি) যেমন থাকবে, তেমনি যন্ত্রপাতি মেরামতের জন্য থাকবে মেকানিজ (৫০) । এ প্র্কল্প হতে একটি কৃষি যন্ত্রপাতি শুমারীও করা হবে । সেই সাথে করা হবে কৃষি যন্ত্রপাতির প্রভাব নিয়ে একটি গবেষণা মূল্যায়ন ।  আধা-কাচা, ভাংগা রাস্তা; না পানি, না শুকনা নদী/খাল পথে কাটা ধান পরিবহণ, জমি থেকে আইল বা রাস্তায় তোলা কৃষকে আর এক ভয়ংকর ক্ষতি ও ভোগান্তিতে ফেলে । এগুলো বিবেচনায় নিয়ে হাওরের রাস্তায় মালামাল নিয়ে টেকসই চলা ও চালনা উপযোগী পরিবহণ ব্যবস্থার সংযোগ এ প্রকল্পে থাকা উচিত । নদী গুলো মরে যাওয়ার প্রেক্ষিতে হাওরে নিরাপদ ও ইজি ডিজাইনের ছোট নৌ-বাহণের উদ্ভাবণ করা দরকার ।
গত ১২ জুন’১৪ বিএআরসি মিলনায়তনে এ প্রকল্পের জাতীয়  কর্মশালা অনুষ্টিত হয় । কৃষি সচিব ড মো নজরুল ইসলাম এতে প্রধান অতথি ছিলেন । কৃষি কর্মকর্তাগণ উপস্থিত ছিলেন । অধিকাংশ বক্তা এ প্রকল্পের কার্যক্রম সবার আগে এবং জরুরীভাবে হাওর এলাকায় বাস্তবায়ন ও সম্প্রসারণের উপর গুরুত্বারোপ করেন । এমনকি এ প্রকল্প পরিচালক এবং কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের (ডিএই) মহা পরিচালক এ বছর ধান কর্তন উপলক্ষ্যে হাওর পরিদর্শণ করেন । নিজ চোক্ষে কৃষকের দুরাবস্থা দেখে তারাও হাওরে সবার আগে ধান কর্তন এবং রোপন যন্ত্রের প্রয়োজনীয়তার কথা স্বীকার করেন । ‘কাজেই কদর বাড়ে’ । তাই মাঠ পর্যায়ে কর্মরত ডিএই এর কয়েক জন কর্মকর্তা ‘হাওরে কৃষি যান্ত্রিকীকরণ’ বিষয়টি কর্মশালায় উপস্থাপন করায় বিষয়টি বেশ গুরুত্ব পায় । সারা দেশে ৫০টি জেলার ২০০ উপজেলায় এ প্রকল্পের কার্যক্রম প্রদর্শন করা হবে । এ তালিকা দেখে আমার চোখ ছানাবড়া । ‘সারা রাত রামায়ন পড়ে সীতা কার বাপ’ এ অবস্থা হয়েছে । হাওর জেলা হিসাবে পরিচিত কিশোরগঞ্জ, নেত্রকোণা, সিলেট, মৌলভীবাজার, বি বাড়িয়া ও সুনামগঞ্জ জেলার কয়েকটি উপজেলার নাম এতে আছে । হবিগঞ্জ জেলার নাম নাই।  কিন্ত প্রকৃত হাওর উপজেলা হিসাবে পরিচিত একটি উপজেলার নামও আমি এ তালিকায় খুজে পায়নি । মনটা আমার ‘হরষে বিষাদ’ এ পরিণত হলো ।
একটি কম্বাইন্ড হার্ভেস্টার বা একটা  রাইস ট্রান্সপ্লান্টারের দাম পরবে যথাক্রমে প্রায় ১০- ২৭ লক্ষ টাকা ও সাড়ে ৩ লক্ষ টাকা । আমাদের অধিকাংশ কৃষক ক্ষুদ্র কৃষক, জমিগুলো খন্ড বিখন্ড । যৌথ ও বড় কৃষক পরিবারগুলো ভেংগে যাওয়ায়  আর্থিক অবস্থাও দুর্বল । সে ভর্তুকি মূল্যেই হোক বা বাকীতেই হোক!  ক’জনের সামর্থ আছে এ যন্ত্র গুলো কেনার? হাওরে বছরে মাত্র একটি ফসল উতপাদন হয় । তাই একটি  কম্বাইন্ড হার্ভেস্টার বা  রাইস ট্রান্সপ্লান্টার মাত্র স্বল্প ক’ দিন  কাজে নিয়োজিত থাকবে । অধিক বিনিয়োগের মূল্যবান এ যন্ত্রগুলো বাকী সময় অলস ভাবে পরে থেকে নষ্ট হবার আশংকার পাশাপাশি বিনিয়োগ উঠে না আসার সম্ভাবনা থেকেই যাবে । যন্ত্রের কার্যকারিতা বা গোলযোগের মতো বড় বিষয়টির দায়বত্বতা কি কৃষক বহণ করতে পারবে? ব্যাংক লোন পাওয়ার কোন নিশ্চয়তা নাই । কয়েক জনে মিলে কিনে নিজেরা ব্যবহার বা ভাড়া খাটাবে, সেটাও জটিল কাজ । সমবায় কালচার এখনো আমাদের মাঝে সেভাবে গড়ে উঠেনি । ব্যক্তি উদ্যোগে অন্যত্র নিয়ে গিয়ে ব্যবহার করাও সম্ভব নয় । তদারককারি কৃষি প্রকৌশলীদের চাকুরি প্রকল্প ভিত্তিক । প্রকল্প শেষ হলে কে দেখবাল করবেন?  তাই বলে কি হাওরের কৃষক সরকারের এ সত ইচ্ছার সুফল হতে বঞ্চিত হবে?  তাদেরই তো সবার আগে এ যন্ত্রগুলো বেশী প্রয়োজন । বঙ্গবন্ধু জার্মানী হতে বিশেষ বিমানে করে জরুরীভাবে এনে অধিক দামের সেচ পাম্প হাওর কৃষকদের মাঝে নাম মাত্র ভাড়ায় বিতরণ করেছিল বলেই  হাওর ‘আজ ও আগামী দিনের খাদ্য ভান্ডার’ এ পরিণত হয়েছে। এ উদাহরণ তো আমাদের সামনে রয়েছেই । তাছাড়া বিআরটিসি’র কোটি টাকা দামের বাস ভাড়ায় নিয়ে কিছু লোক নিজেরা লাভবান হয়ে জনগণকে সেবা দিচ্ছে! সেক্ষে্ত্রে কৃষকের পক্ষ্যে সরকারের টাকায় কেনা কম্বাইন্ড হার্ভেস্টার এবং রাইস ট্রান্সপ্লান্টার ভাড়ায় ব্যবহারের সুযোগ দাবী করা অযৌক্তিক হবে না। এটা বরং অধিক যুক্তিযুক্ত এবং জন গুরু্ত্বপূর্ণ। এ ব্যবস্থা থাকা উচিত। বংগবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা, তার সরকারের অর্জন- খাদ্য নিরাপত্তার নিশ্চয়তা বিধানের স্বার্থে হাওর অঞ্চলে সর্বাগ্রে এবং অধিক প্রয়োজনীয় কম্বাইন্ড হার্ভেস্টার এবং রাইস ট্রান্সপ্লান্টার বেশি পরিমাণে বরাদ্দের দাবী জানাছি। সে-টা ভর্তুকি মূল্যে কিনে নয়, ন্যায্য ভাড়ায় সেবা প্রাপ্তির। ‘খামার যান্ত্রিকীকরণের মাধ্যমে ফসল উতপাদন বৃদ্ধি প্রকল্প’-২য় পর্যায়ের প্রদর্শণী ও মাঠ দিবসসহ সকল কার্যক্রমে হাওর উপজেলা সমূহ অর্ন্তভূক্ত থাকবে এ আশাবাদ আমরা করতেই পারি । কারণ, ‘মাছে ভাতে বাংগালী’র যোগানদাতা হাওরবাসি।


niazpashaড নিয়াজ পাশা, কৃষি প্রকৌশলী ও  হাওর ভূমিপুত্র। সাবেক ভিপি, ফজলুল হক হল ছাত্র সংসদ, বাকৃবি, ময়মনসিংহ। সার্ক এগ্রিকালচার সেন্টার, ঢাকা । ফোন: ০১৭২৭ ০৭৪ ৫৮৪ niazpasha@yahoo.com ; www.saarcagri.org

Leave a Comment

You must be logged in to post a comment.