সেচ ব্যবস্থাপনা ও জিপসাম প্রয়োগের মাধ্যমে দেশের উপকূলীয় লবণাক্ত জমিতে গমের চাষ

বাংলাদেশে দানাজাতীয় ফসল হিসেবে গম দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে। জনগনের মধ্যে স্বাস্থ্য সচেতনতা বৃদ্ধির ফলে ক্রমেই আটার রুটির চাহিদা বাড়ছে। বিভিন্ন কারণে যেমন, অন্যান্য রবি ফসলের সাথে প্রতিযোগীতায় গমের চাষাবাদ তেমন বাড়ছে না। দেশের দক্ষিনাঞ্চলের উপকূলীয় এলাকায় লবনাক্ততার কারণে গমের চাষাবাদ বাধাগ্রস্থ হচ্ছে।

বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চল মূলত: সুমুদ্রে পলল দ্বারা গঠিত ভূমি। ফলে মাটিস্তর এবং ভূ-গর্ভস্থ পানিতে বিভিন্ন মাত্রার লবনাক্ততা রয়েছে। যতই সুমুদ্রের কাছাকাছি যাওয়া যায়, লবনাক্ততার মাত্রা ততই বাড়তে থাকে। বর্ষাকালে প্রচুর বৃষ্টিপাতের দরুন বিধৌতকরনের ফলে আমন মৌসুমে মাটিতে লবনাক্ততার মাত্রা কম থাকে। বর্ষা শেষে পূণরায় যখন মাটির উপরের স্তর শুষ্ক হতে থাকে, বাষ্পীয়ভবনের ফলে মাটিস্তর থেকে লোনা পানির উর্দ্ধমুখী প্রবাহ শুরু হয়, এবং শুধুমাত্র পানি বাষ্পীয় আকারে চলে যায় ও লবণ মাটিতে থেকে যায়। ফলশ্রুতিতে মাটিতে লবণের পরিমাণ বাড়তে থাকে। ফলে রবি মৌসুমে ফসলের স্বাভাবিক বৃদ্ধি বাধাগ্রস্থ হয় ও ফলন কম হয়।

এ সমস্ত এলাকায় ফসলের সন্তোষজনক ফলনের জন্য দরকার বিভিন্ন ফসলের লবণ সহিষ্ণু জাত নির্বাচন, বিদ্যমান লোনা ও স্বাদু (পুকুর/খালে জমাকৃত বৃষ্টির) পানির সমন্বিত ব্যবহার এবং সঠিক মাত্রার সারের ব্যবহার।

বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিনা) এর কৃষি প্রকৌশল বিভাগ কর্তৃক ইতিপূর্বে এক গবেষণা ফলাফলে লবনাক্ত এলাকার জন্য জমি: পুকুর – এর অনুপাত ২০: ১ রাখার সুপারিশ করা হয়েছে (পুকুরের গভীরতা ২.৫ মি.), যার দ্বারা শীতকালীন শস্য যেমন সরিষা, তিল, গম ইত্যাদিতে ২-১ টি সেচ দিয়ে শস্য চাষ করা যায়।

গমের জাত নির্বাচনঃ

লবনাক্ত এলাকার জন্য সুপারিশকৃত জাতসমূহ – যেমন ’’বিনাগম-১’’, ’’বারি গম ২৫’’।

বপনের সময়ঃ

উপকূলীয় লবনাক্ত এলাকায় সাধারনত: আমন ধান কর্তন ও জমি ’’জো’’ আসতে দেরী হয়। ’’জো’’ আসা মাত্রই জমি চাষ করে বীজ বপন করতে হবে। ডিসেম্বরের ৭ (২৩ অগ্রহায়ণ) তারিখে বপন করেও (শ্যামনগর, সাতক্ষীরা সন্তোষজনক ফলন পাওয়া গেছে। তবে দেরীতে বপন করলে প্রাকৃতিক দূর্যোগ যেমন ঝড়, শিলাবৃষ্টি, জলোচ্ছাস ইত্যাদি দ্বারা ক্ষতির সম্ভাবনা থাকে।

বপন পদ্ধতি ও অমত্মবর্তীকালীন পরিচর্যাঃ

স্বাভাবিক জমিতে চাষকৃত অন্যান্য জাতের মতই। সারিতে বপন করলে (সারি থেকে সারির দূরত্ব ২০ সেমি.) ভাল ফলন পাওয়া যায়। নিড়ানী ও পাতলাকরণের সময় গাছ থেকে গাছের গড় দূরত্ব  ৫.০ সেমি. রাখা ভাল।

বপনের সময় যদি মাটির আদ্রতা (রস) খুব কমে যায়, তবে বপনের পর সেচ (ঝরনার সাহায্যে লাইনে, বা হালকা প্লাবন সেচ) দেওয়ার প্রয়োজন হতে পারে। মাঝারী আর্দ্রতার মাটিতে বপনের পূর্বে প্রাইমিং (অর্থ্যাৎ, ১২-১৪ ঘন্টা পনিতে ভিজিয়ে রেখে উঠানোর পর ৬ ঘন্টা হালকা রোদে শুকানো) করে বপন করলে অংকুরোদগম ভাল হয়।

সারের স্বাভাবিক মাত্রাঃ

হেক্টরপ্রতি ইঊরিয়া, টি.এস.পি., মিউরেট অফ পটাশ, জিপসাম, জিংক সালফেট ও বরিক এসিড- এর স্বাভাবিক মাত্রা যথাক্রমে: ২২০, ১৫০, ১৪০, ৯০, ৬ ও ৬ কেজি। এছাড়াও প্রতি হেক্টরে ৫.০ টন পঁচা গোবর বা কম্পোষ্ট ব্যবহার করা ভাল।

উদ্ভাবিত প্রযুক্তিঃ

সাতক্ষীরা জেলার শ্যামনগর  এলাকায় লবনাক্ত এলাকায় গম ফসলের উপর বিভিন্ন মাত্রার লবনাক্ত পানির ও জিপসাম-পটাশ প্রয়োগের প্রভাব নিয়ে গবেষণার মাধ্যমে নিম্নোক্ত ফলাফল পাওয়া গেছে:

(১) ৭-৮ ডি.এস. মাত্রার লবনাক্ত পানি ও বৃষ্টির  (পুকুরে জমাকৃত)  পানির পর্যায়ক্রমিক সেচ, এবং ৯০% অতিরিক্ত জিপসাম (উপরে উল্লেখিত  স্বাভাবিক মাত্রার চেয়ে)  প্রয়োগের মাধ্যমে ভাল  ফলন (৩.৫-৪.০ টন/হে) পাওয়া যায়।

অর্থাৎ, লবনাক্ত পানির সেচ – পুকুরের  পানির সেচ – লবনাক্ত পানির সেচ – পুকুরের  পানির সেচ। বপনের ১৮-২০, ৩৫-৩৭, ৫২-৫৫ ও ৬২-৬৫ দিন পর (অর্থ্যাৎ, সি.আর.আই., কুশি বৃদ্ধির শেষ পর্যায়, থোড় বৃদ্ধি পর্যায়, ও ফুল আসার পর) সেচ দিতে হয়।

(২) ১০-১২ ডি.এস. মাত্রার লবনাক্ত পানির ৩টি সেচ, অর্থাৎ বপনের ১৮, ৩৫, ও  ৫৫ দিন পর এবং এতদসংগে ৯০% অতিরিক্ত জিপসাম প্রয়োগের মাধ্যমে  সন্তোষজনক ফলন (২.৫-৩ টন/হে) পাওয়া যায়।

সম্পূর্ণ জিপসাম সার (মোট ১৬২ কেজি/হেক্টর) জমি তৈরীর সময়, বা অর্ধেক ১ম সেচের সময় ও বাকী অর্ধেক ৩য় সেচের সময় প্রয়োগ করা যায়।

ইউরিয়া সারের অর্ধেক শেষ চাষের সময় প্রয়োগ করতে হয়। বাকী ইউরিয়া ১ম সেচ ও ৩য় সেচের সময় অর্ধেক করে প্রয়োগ করা যায়।

এভাবে বাংলাদেশে দক্ষিনাঞ্চলের লবনাক্ত জমিতে গমের চাষাবাদের মাধ্যমে একদিকে কৃষকেরা অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হবে এবং অন্যদিকে দেশে গমের ক্রমবর্ধমান চাহিদাও মেটানো সম্ভব হবে।

লেখকঃ

ড. মোঃ হোসেন আলী (প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা) ও মোঃ আকতারুল ইসলাম (বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা)

কৃষি প্রকৌশল বিভাগ, বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিনা), ময়মনসিংহ-২২০২।

ই-মেইল: aktarul.bau@gmail.com

Leave a Comment

You must be logged in to post a comment.