বাকৃবি গবেষকের সাফল্যঃ বাড়ির ছাদে “মাছ ও সবজির সমন্বিত চাষ”

[মো. আশরাফুল আলম | বাকৃবি সংবাদদাতা]

বাংলাদেশে ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার চাপকে লাগবের লক্ষ্যে ভার্টিক্যাল (লম্বালম্বি) চাষাবাদের দিকে ঝুঁকছে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ। বাংলাদেশও এখন আর পিছিয়ে নেই। তাই দেশের প্রচলিত হরাইজন্টাল (সমান্তরাল) চাষাবাদের পাশাপাশি নতুন ওই চাষাবাদের জনপ্রিয়তা বাড়ানোর পরামর্শ দিয়েছেন কৃষি বিজ্ঞানীরা। এ ক্ষেত্রে বাড়ির ছাদ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বলে জানান কৃষি বিজ্ঞানীরা। কারণ হিসেবে উঠে এসেছে উলম্ব পদ্ধতিতে চাষাবাদ করতে খুবই স্বল্প পরিমাণ জমির প্রয়োজন হয় কিন্তু ফলন পাওয়া যায় অনেক বেশি।
বর্তমানে বাজারে প্রাপ্ত অধিকাংশ শাক-সবজিতে উচ্চ মাত্রার যেসব কীটনাশক ও রাসায়নিক সার প্রয়োগ করা হয় তার মূল্যও অনেক বেশি। আর তাই কৃষকরা যেমন একদিকে আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে তেমনি ঘটছে মারাতœক স্বাস্থ্যহানী। এসব দিককে কেন্দ্র করে সম্পূর্ণ জৈব পদ্ধতিতে একই সাথে মাছ ও সব্জির চাষ করার পদ্ধতি আবিষ্কার করার জন্য দীর্ঘদিন ধরে গবেষণা করে আসছেন বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাকৃবি) মাৎস্যবিজ্ঞান অনুষদের একোয়াকালচার বিভাগের প্রফেসর ড. এম এ সালাম
গবেষক ড. সালাম জানান, বাড়ির ছাদে কিংবা আঙিনায় সমন্বিত এই পদ্ধতিতে মাছ ও সবজি চাষ করতে কোন প্রকার রাসায়নিক সার বা কীটনাশকের প্রয়োজন হয় না। ফলে উৎপাদিত মাছ ও সবজি খুবই স্বাস্থ্যসম্মত। এছাড়া এই পদ্ধতিতে মাটি ছাড়াই সম্ভব হবে সবজি চাষ। সমন্বিত মাছ ও সবজি চাষের এই পদ্ধতিকে বলা হয় একোয়াপনিক্স (Aquaponics)।

BAU Research News of Fish & Vegetable Cultivation in Vartically Pic (1)তিনি আরও বলেন, অধিক ফলনের আশায় বর্তমানে চাষীরা ফসলে রোগবালাই প্রতিরোধে কীটনাশক, উৎপাদন বৃদ্ধিতে রাসায়নিক সার এবং দ্রুতবর্ধনশীল এন্টিবায়োটিকের প্রয়োগ কয়েকগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। যার ফলে মানুষের স্বাস্থ্য মারাত্মক ঝুঁকির মধ্যে পড়ছে। বিশেষ করে শহরে বসবাসকারী মানুষেরাই এ ঝুঁকির শিকার হচ্ছেন তুলনামূলকভাবে বেশী। এমতাবস্থায় বাড়ির ছাদে অথবা আঙ্গিনায় ট্যাঙ্কে মাছ চাষ করে এবং ট্যাঙ্কে ব্যবহৃত সেই পানি ব্যবহার করে কোন প্রকার রাসায়নিক সার ব্যবহার না করে শাক-সবজি উৎপাদন করা সম্ভব। এছাড়া এই পদ্ধতি খরা ও উপকূলীয় লবনাক্ত অঞ্চলের জন্য  খুবই উপযোগী কারণ এতে প্রায় ৯০-৯৫ শতাংশ পানি কম লাগে।
BAU Research News of Fish & Vegetable Cultivation in Vartically Pic (3)তার গবেষণালব্ধ ফল হিসেবে পাওয়া সমন্বিত এই পদ্ধতি সমন্ধে ড. সালাম বলেন, বাড়ীর আঙিনায় বা বাসার ছাদের আয়তনের উপর নির্ভর করে যেকোন আকারের প্লাস্টিক ট্যাঙ্ক অথবা ড্রামের মধ্যে পানি দিয়ে সেখানে তেলাপিয়া, মাগুর, কই, পাঙ্গাসসহ বিভিন্ন দেশীয় জাতের মাছ চাষ করেন। আর সবজি চাষের জন্য একটি কাঠের আলনা তৈরী করে তাতে তিন সারিতে উল্টো করে একটির নিচে আরেকটি দুইপাশে কাটা প্লাস্টিকের বোতল বসিয়ে তাতে নুড়ি পাথর দিয়ে সবজির চারা লাগাতে হবে। এবার মাছের ট্যাঙ্কের পানি বালতি করে উপরে তুলে সেখান থেকে সাইফোন প্রক্রিয়ায় ফোটাফোটা করে উপরের ওই চারা লাগানো বোতলে সরবরাহ করতে হবে। এই পানি পর্যায়ক্রমে উপর থেকে নিচে আরও দুটি বোতলের মধ্য দিয়ে গড়িয়ে একটি পাত্রে এসে জমা হয় যা পুণরায় মাছের ট্যাঙ্কে ব্যবহার করা হয়। বিশেষ করে মাছের ট্যাঙ্কের অ্যামোনিয়া  সমৃদ্ধ পানি গাছের শিকড়ে অবস্থিত ডি-নাইট্রিফাইং ব্যাকটেরিয়া ভেঙ্গে গাছের খাদ্য উপযোগী নাইট্রেটে পরিণত করে পানিকে দূষণ মুক্ত করে এবং ওই পানিকে পুণরায় মাছের ট্যাঙ্কে ব্যবহার উপযোগী করে তোলে। এ পদ্ধতিতে বিভিন্ন দেশী-বিদেশী শাকসবজি চাষ করা যায়। তবে টমেটো, শসা, করোল্লা, শিম, ব্রকলি, পুদিনা, বেগুন, দেশী লেটুসসহ আমেরিকান লেটুস ফলন বেশ ভাল হয়।
মাছকে কি রকমের খাবার দিতে হবে এমন প্রশ্নের উত্তরে ড. সালাম বলেন, ‘এই পদ্ধতিতে সবজি চাষের জন্য বাড়তি কোন প্রকার সার বা মাটির প্রয়োজন না পড়লেও মাছকে আলাদা খাদ্য বাইরে থেকে সরবরাহ করতে হবে। বাজার থেকে কিনে মাছকে যাতে খাদ্য দিতে না হয়, সেজন্য আমাদের চারপাশে ঘুরে বেড়ানো “কালো সৈনিক” পোকার লার্ভা মাছের প্রিয় খাদ্য হিসেবে ব্যবহার করা যায়। এটি মাছের খুবই প্রিয় খাবার। এতে প্রচুর প্রোটিন, লিপিড এবং বিভিন্ন প্রকার খনিজ লবন রয়েছে যা মাছের দ্রুত বর্ধনে সাহায্য করে।
নতুন এই প্রযুক্তি নিয়ে ভবিষ্যত পরিকল্পনা সম্পর্কে ড. সালাম বলেন, যেহেতু প্রতিনিয়তই আমাদের দেশের চাষাবাদের জন্য জমির পরিমাণ কমছে তাই উলম্ব পদ্ধতিটি অনেকাংশে আমাদের সাহায্য করবে বলে আশা প্রকাশ করছি। কারণ, উলম্ব পদ্ধতিতে একই জায়গায় অনেকগুলো ফসল একসাথে উৎপাদন করা যায়। এর ফলে একদিকে যেমন জমির পরিমাণের উপর চিন্তা করতে হচ্ছে না, অন্যদিকে কীটনাশক ও রাসায়নিক ক্ষতিকর পদার্থেও হাত থেকেও রক্ষা পাওয়া যাবে। তাছাড়া খরচ ও জায়গা কম লাগায় এই পদ্ধতির মাধ্যমে আর্থিকভাবেও লাভবান হওয়া সম্ভব বলে মনে করেন তিনি। এছাড়া পরিবর্তনশীল জলবায়ুতে এই সমন্বিত কৃষি প্রযুক্তি হতে পারে একটি বিকল্প।

Ashraful Alam Journalist BAUমো. আশরাফুল আলমঃ ছাত্র ও সাংবাদিক,

বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহ।

Leave a Comment

You must be logged in to post a comment.