ভিয়েতনাম কই মাছের চাষ ব্যবস্থাপনা

১. পটভূমি
কই (Anabas testudineus) আমাদের দেশী প্রজাতির একটি ছোট মাছ। সবুজাভ-সোনালী বর্ণের এই মাছ আদিকাল থেকে আমাদের বিলে-ঝিলে সহজেই পাওয়া যেত। কই মাছ বাংলাদেশসহ এশিয়ার ১৭ টি দেশে পাওয়া যায়; তবে প্রজাতি একই হলেও দেশভেদে কই মাছের বর্ণ, স্বাদ, ও বৃদ্ধি হার বিভিন্ন রকম। বাংলাদেশে প্রাকৃতিক জলাভূমির পরিমাণ দিনে দিনে কমে যাওয়ায় দেশী জাতের সুস্বাদু এই মাছটির প্রাপ্যতাও কমে যাচ্ছে। পুকুরে দেশী কই মাছের বৃদ্ধি কম হয়, তাই ২০০২ সালে থাইল্যান্ড থেকে একই প্রজাতির দ্রুত বর্ধনশীল জাতের থাই কই বাংলাদেশের মৎস্যচাষে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। কিন্তু হ্যাচারিতে পোনা উৎপাদনের ক্ষেত্রের ইনব্রিডিং বিষয়ে সতর্কতা অবলম্বন না করায় থাই কই সহজেই এর দ্রুত বর্ধণশীল বৈশিষ্ট্য হারিয়ে ফেলে। এছাড়া ফ্যাকাসে বর্ণের কারণে চাষীরাও বাজারে ন্যায্য মূল্য পাচ্ছিল না। এ অবস্থা থেকে উত্তরণের লক্ষ্যে স্বর্ণলতা এগ্রো ফিশারিজ লিঃ ২০১১ সালে ইনোভিশন কনসালটিং (প্রাঃ) লিঃ ও ক্যাটালিস্ট-এর সহায়তায় ভিয়েতনাম থেকে দ্রুত বর্ধণশীল জাতের ভিয়েতনাম কই মাছের ব্রুডস্টক সংগ্রহ করে। ভিয়েতনাম কই-এর রঙ ও স্বাদ অনেকটাই দেশী কই-এর মত কিন্তু খুব দ্রুত বৃদ্ধি পায়।

২. ভিয়েতনাম কই মাছ চাষের গুরুত্ব
# এই মাছ দ্রুত বর্ধনশীল। ৪ মাসে ১৫০-২০০ গ্রাম ওজন হয়।
# বাংলাদেশের আবহাওয়া ও জলবায়ু এ মাছ চাষের উপযোগী।
# বর্ণ ও স্বাদ দেশী কই মাছের মত, তাই বাজার মূল্যও বেশী।
# চাষ ব্যবস্থাপনা সহজ ও লাভের পরিমান অন্য মাছের চেয়ে বেশী।
# শিং-মাগুরের সাথে মিশ্রচাষে ৪ মাসেই শিং-মাগুর বাজারজাত করা যায়।
৩. ভিয়েতনাম কই মাছের চাষ
৩.১ পুকুর নির্বাচন
ভিয়েতনাম কই মাছ চাষের জন্য কম কাদাযুক্ত এবং ৪-৬ মাস পানি থাকে এমন ১৫-১০০ শতাংশ আয়তনের পুকুর নির্বাচন করতে হবে। তবে এর চেয়ে ছোট বা বড় পুকুরেও এ মাছ চাষ করা যায়।৩.২ ৩. ৩.২ পুকুর প্রস্তুতি
# পুকুর সেচে পানি শুকিয়ে অবাঞ্ছিত মাছ ও অন্যান্য প্রাণী দূর করতে হবে।
# পুকুরের তলায় অতিরিক্ত কাদা থাকলে তা উঠিয়ে ফেলতে হবে।
# পুকুরের পাড় মেরামত করতে হবে এবং পাড়ে গাছ-পালা থাকলে ডাল কেটে দিতে হবে।
# প্রতি শতাংশে ১ কেজি হারে চুন/ব্লিচিং পাউডার প্রয়োগ করা আবশ্যক।
# চুন/ব্লিচিং প্রয়োগের ৩ দিন পরে পুকুরে পানি দিতে হবে।
# পুকুরে পানি দেয়ার ২-৩ দিন পর পোনা মজুদ করতে হবে।

৩.৩ পোনা সংগ্রহ
পুকুরে চাষের জন্য ভিয়েতনাম কই মাছের পোনা স্বর্ণলতা এগ্রো ফিশারিজ লিঃ-এর হ্যাচারী থেকে সংগ্রহ করা যাবে। পোনা পলিথিন ব্যাগে অক্সিজেন দিয়ে পরিবহণ করতে হবে।
৩.৪ পোনা মজুদ
০.১৫-০.২০ গ্রাম (৬০০০-৫০০০ টি/কেজি) আকারের সুস্থ-সবল পোনা ৩.৩ পোনা সংগ্রহ
পুকুরে চাষের জন্য ভিয়েতনাম কই মাছের পোনা স্বর্ণলতা এগ্রো ফিশারিজ লিঃ-এর হ্যাচারী থেকে সংগ্রহ করা যাবে। পোনা পলিথিন ব্যাগে অক্সিজেন দিয়ে পরিবহণ করতে হবে।
৩.৪ পোনা মজুদ
০.১৫-০.২০ গ্রাম (৬০০০-৫০০০ টি/কেজি) আকারের সুস্থ-সবল পোনা নিম্নোক্ত ছক অনুযায়ী চাষের পুকুরে মজুদ করা যেতে পারে। মজুদের সময় পোনা পুকুরের পানির সাথে খাপ খাইয়ে ছাড়তে হবে।

ভিয়েতনাম কই মাছের মজুদ ঘনত্ব

…………………………………………….মজুদ ঘনত্ব / শতাংশ…………………
মাছের প্রজাতি      একক চাষ         মিশ্র চাষ – ১         মিশ্র চাষ – ২         মিশ্র চাষ – ৩
ভিয়েতনাম কই    ৬০০-৮০০        ৫০০-৬০০           ৪০০-৫০০           ৩০০-৪০০
শিং/ মাগুর           –                        ১০০                     ১২০                     ১৫০
রুই                       –                        ২                          ২                          ২
সিলভার কার্প       –                        ৩                          ৩                          ৩
মৃগেল                   –                        –                           ১                           ২
সরপুঁটি                 –                        –                           ৩                           ৩

# পোনা মজুদের সময় কিছু পোনা মারা যায় তাই ১৫-২০% পোনা বেশী মজুদ করা ভাল।

৩.৫ ভিয়েতনাম কই মাছের পুষ্টি চাহিদা
ভিয়েতনাম কই মাছের আমিষ চাহিদা ৩৫-৪০%। পুকুরের প্রাকৃতিক খাদ্য হতে আমিষের চাহিদা কিছুটা পূরণ হলেও ভিয়েতনাম কই মাছ চাষের জন্য পুকুরে উচ্চ আমিষযুক্ত ভাসমান খাদ্য প্রয়োগ করা উচিত।
ভিয়েতনাম কই মাছের খাদ্য প্রয়োগ তালিকা

আকার             প্রয়োগ হার             প্রয়োগ মাত্রা
(টি/কেজি)     (দেহ ওজনের)
————————————————
-৫০০০                 ১০০%                   ৪ বার
৪০০০                    ৭৫%                    ৪ বার
৩০০০                    ৫০%                   ৩ বার
২০০০                     ৪০%                  ৩ বার
১০০০                     ৩৫%                  ৩ বার
৮০০                      ৩০%                   ২ বার
৫০০                      ২৫%                   ২ বার
৪০০                      ২০%                   ২ বার
৩০০                      ১৫%                   ২ বার
১০০                       ১২%                   ২ বার
৭৫                         ১০%                    ২ বার
৫০                          ৮%                     ২ বার
৪০                          ৭%                      ২ বার
২৫                          ৫%                      ২ বার
১৫                           ৩%                     ২ বার
১০ –                       ২.৫%                   ২ বার

৩.৬ অন্যান্য ব্যবস্থাপনা
# প্রতি ৭-১০ দিন পর পর জাল টেনে মাছের বৃদ্ধি পর্যবেণ করে খাবারের পরিমাণ নির্ধারণ করতে হবে।
# মাছ ১০০টি/কেজি হওয়া পর্যন্ত নার্সারি খাদ্য সমস্ত পুকুরে প্রয়োগ করতে হবে।
# মাছ নিয়মিত খাবার খায় কিনা সেদিকে সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে।
# পোনা মজুদের ১ মাস পর হতে প্রতি মাসে শতাংশ প্রতি ১৫০ গ্রাম হারে জিওলাইট প্রয়োগ করতে হবে।
# মজুদ পুকুরে ১ মাস পর থেকে প্রতি ১৫-২০ দিন অন্তর ২০-৩০% পানি পরিবর্তন করা উত্তম।
# প্রতি ১৫ দিন অন্তর পানির গুণাগুণ যেমন পানির তাপমাত্রা, অক্সিজেন, পিএইচ, অ্যামোনিয়া ও মোট ক্ষারত্ব পরীক্ষা করা ভাল। অ্যামোনিয়ার পরিমাণ বেড়ে গেলে বাজারে প্রচলিত এ্যাকোয়া-কেমিক্যাল ব্যবহার করে অ্যামোনিয়া দুরীকরণের ব্যবস্থা গ্রহন করেত হবে।
৪. মাছ আহরণ ও উৎপাদন
আধা-নিবিড় পদ্ধতিতে চাষ করলে ৩-৪ মাসে ভিয়েতনাম কই মাছের গড় ওজন ১৫০-২০০ গ্রাম হবে। জাল টেনে ও পুকুর শুকিয়ে মাছ ধরতে হবে। এ পদ্ধতিতে ৩-৪ মাসে একর প্রতি ৯-১৫ টন উৎপাদন পাওয়া সম্ভব।
৫. ভিয়েতনাম কই মাছের রোগ/স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা
উচ্চ মজুদ ঘনত্ব ও বদ্ধ জলজ পরিবেশে উচ্ছিষ্ট খাবার, মাছের বিপাকীয় বর্জ্য, ও অন্যান্য বর্জ্য পচে পানি দূষিত হয়ে কই মাছের রোগের ঝুঁকি বৃদ্ধি পায়। খামারে একবার জীবাণু প্রবেশ করলে তাকে নির্মূল করা খুব কঠিন। তাই খামারে জীবাণু প্রবেশের পূর্বেই প্রতিরোধ ব্যবস্থা গ্রহন করতে হবে। নিম্নলিখিত সতর্কতা অবলম্বনের মাধ্যমে রোগের ঝুঁকি কমানো সম্ভব –
# ইনব্রিড/ক্রসব্রিডমুক্ত সুস্থা ও সবল পোনা সংগ্রহ করা।
# খামার ও মাছ চাষের সকল সরঞ্জাম জীবাণু মুক্ত রাখা।
# এক খামারের মাছ ধরার জাল অন্য খামারে ব্যবহার না করা।
# খামারের পানি নিয়মিত পরীক্ষা করা।
# উচ্চ মজুদ হার পরিহার করা।
# পরিমিত ও সুষম খাবার প্রয়োগ।
# খামার ও মাছের পরিচর্যা নিশ্চিতকরণ।
পরিবহণের সময় পোনা আঘাত পেলে তরোগের সম্ভাবনা বৃদ্ধি পায়। এ ছাড়া পালন পুকুরেও কই মাছের তরোগ হতে পারে। এরোগ প্রতিরোধ ও প্রতিকারের জন্য নিম্নোক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করা যেতে পারে –
# ক্ষতরোগ প্রতিরোধে শীতের শুরু হতে ১৫ দিন পর পর প্রতি শতাংশে ২৫০ গ্রাম লবন ও ১৫০ জিওলাইট প্রয়োগ করতে হবে।
# তরোগের প্রাদুর্ভাব হলে পুকুরে জীবানুনাশক ব্যবহার করতে হবে। এন্টিবায়োটিক হিসাবে প্রতি কেজি খাবারে ৫ গ্রাম অক্সিটেট্রাসাইকিন ও ২ গ্রাম ভিটামিন-সি মিশিয়ে ১০ দিন প্রয়োগ করতে হবে ।

৬. প্রয়োজনীয় অন্যান্য পরামর্শ
# খাবার প্রয়োগের ১ ঘন্টা পর পুকুর পর্যবেণ করা উচিত। যদি পুকুরে খাবার পাওয়া যায় তাহলে বুঝতে হবে পুকুর/মাছের কোন সমস্যা হয়েছে অথবা খাবার বেশী দেওয়া হচ্ছে।
# গ্রীষ্মকালে অনেক সময় পুকুরের পানি কমে যায় ফলে পানির তাপমাত্রা বেড়ে যায়। এক্ষেত্রে পুকুরে প্রয়োজনীয় পরিমান পানি দিতে হবে।
# একটানা মেঘলা আবহাওয়ায় কিংবা অতিরিক্ত বৃষ্টি হলে খাবারের পরিমাণ কমিয়ে দিতে হবে অথবা খাবার দেয়া বন্ধ রাখতে হবে।
# প্রতিবার নতুন করে ভিয়েতনাম কই মাছ চাষ শুরু করার সময় অবশ্যই সম্পূর্ণ পুকুর শুকিয়ে তারপর পুকুর প্রস্তত করতে হবে।

এই অনুচ্ছেদটি লিখেছেনঃ
ড. জাহিদ পারভেজ সুখন
পরিচালক, স্বর্ণলতা এগ্রো-ফিশারিজ লিঃ
রাধাকানাই, ফুলবাড়ীয়া, ময়মনসিংহ।
ই-মেইল : safagrofisheries@gmail.com
ওয়েব সাইট : www.sharnalata.com
ফেসবুক পেইজ : www.facebook.com/safhatchery
ফোন: ০১৬১৭ ৮৮৮ ৬১৮

Leave a Comment

You must be logged in to post a comment.