কৈ, শিং ও মাগুর মাছের চাষ ব্যবস্থাপনা
খাদ্য ব্যবস্থাপনাঃ
মাছের অধিক উৎপাদন প্রাপ্তির জন্য ভালো বীজের অর্থাৎ পোনার যেমন প্রয়োজন তেমনই ভালোমানের খাদ্যের নিশ্চয়তা বিধান জরুরী। মাছের স্বাভাবিক বৃদ্ধির জন্য অন্যান্য প্রাণীর ন্যায় খাদ্যে নির্ধারিত মাত্রায় সকল পুষ্টি উপাদান থাকা প্রয়োজন। মাছ তার দৈহিক বৃদ্ধি ও পুষ্টির জন্যে পুকুরে প্রাপ্ত খাদ্যের ওপর সম্পূর্ণ নির্ভরশীল। বাণ্যিজিকভাবে লাভজনক উপায়ে মাছচাষ করতে গেলে মাছের মজুদ ঘনত্ব বাড়াতে হবে। কৈ মাছের এরুপ চাষের ক্ষেত্রে কেবল মাত্র প্রাকৃতিক খাদ্যের ওপর নির্ভর করে ভালো ফলন পাওয়া সম্ভব নয়। নিবিড় মাছচাষে সম্পূরক খাদ্যের ব্যবহার খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এক্ষেত্রে প্রাকৃতিক খাদ্যের পাশাপাশি সূষম দানাদার খাদ্য প্রয়োগ আবশ্যক। সূষম খাবার প্রয়োগের মাধ্যমে নির্দিষ্ট সময়ে কাঙ্খিত উৎপাদন নিশ্চিত করা সম্ভব হয়। এছাড়া সুষম খাবার প্রয়োগে উৎপাদিত মাছের condition factor সমুন্নত থাকে।
খাদ্যে পুষ্টি উপাদানের উৎসঃ
মাছের সম্পূরক খাদ্য প্রস্তুতে বিভিন্ন পুষ্টি উপাদানের জন্য বিভিন্ন ধরণের খাদ্য উপকরণ ব্যবহার করা হয়ে থাকে। খাদ্যের এ সকল উপকরণ প্রধানতঃ প্রাণিজাত এবং উদ্ভিদজাত উৎস থেকে পাওয়া যায়। আমাদের দেশে মাছের খাদ্য প্রস্তুতে বহুলভাবে ব্যবহৃত চালের মিহিকুড়া, গমের ভুসি, চালের খুদ, আটা, সরিষার খৈল, তিলের খৈল, সোয়াবিন মিল, ভুট্টা চূর্ণ প্রভৃতি উদ্ভিদজাত এবং ফিশমিল, Meat and Bonemeal গবাদিপশুর রক্ত ইত্যাদি প্রাণিজাত উপকরণ। মাছের দেহ বৃদ্ধির জন্য আমিষের ভুমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মাছের খাদ্যে আমিষের পাশাপাশি পরিমাণমত শর্করা, চর্বি বা ফ্যাট, Vitamin ও খনিজজাতীয় পুষ্টি উপাদান পরিমাণ মত অবশ্যই থাকতে হবে। সাধারণত কৈ, মাগুর মাছের খাদ্যে ৩০-৩৫% আমিষ থাকা প্রয়োজন। কারণ এসকল মাছ প্রাণীঝ আমিষ উৎসজাত খাবার গ্রহণে অভ্যস্ত। সচরাচর ব্যবহৃত কিছু খাদ্য উপকরণের পুষ্টিমান নিচের সারণীতে দেয়া হলোঃ-
উপাদান আমিষ শর্করা চর্বি
চালের কুঁড়া ১১.৮৮ ৪৪.৪২ ১০.৪৫
গমের ভুসি ১৪.৫৭ ৬৬.৩৬ ৪.৪৩
সরিষার খৈল ৩০.৩৩ ৩৪.৩৮ ১৩.৪৪
তিলের খৈল ২৭.২০ ৫৪.৯৭ ১৩.১৮
ফিশমিল-এ গেড ৫৬.৬১ ৩.৭৪ ১১.২২
ব্লাড মিল ৬৩.১৫ ১৫.৫৯ ০.৫৬
খাদ্য উপকরণ নির্বাচনে বিবেচ্য বিষয়ঃ
আমাদের অধিকাংশ মৎস্য চাষি সম্পূরক খাবার হিসাবে প্রধানত সরিষার খৈল, চাউলের কুঁড়া ও গমের ভুসি ব্যবহার করে। এ ছাড়াও অনেক মাছচাষি এমন কিছু খাদ্য উপকরণ ব্যবহার করেন, যেগুলো আর্থিক ভাবে লাভজনক নয়, এমনকি সেগুলো অনেক সময় পুকুরের পরিবেশের জন্য তিকর হয়ে থাকে। যেমনঃ ধানের তুষ বা কুঁড়া মাছের ফুলকায় আটকিয়ে শ্বাসরোধ করে মাছের মৃত্যুর কারণ ঘটায়। খামারের নিজস্ব উদ্যোগে সম্পুরক খাদ্য প্রস্তুত করলে প্রজতিভিত্তিক খাদ্যের পুষ্টিগুণ বিচারে খাদ্য তৈরি করা উত্তম। পুকুরে সম্পূরক খাদ্য প্রয়োগের উদ্দেশ্য হলো মাছের অধিক উৎপাদন নিশ্চিত করা। সে কারণে মাছের খাদ্য হিসাবে ব্যবহারের জন্য উপকরণ নির্বাচনের সময় বেশ কিছু বিষয় বিবেচনা করা উচিত যা নিম্নে উল্লেখ করা হলোঃ-
ক্স স্থানীয় ভাবে উপকরণসমূহের প্রাচুর্যতা
ক্স উপকরণের পুষ্টিমান
ক্স উপকরণের Comparative price
ক্স মাছের খাদ্যাভ্যাস বা পুষ্টি চাহিদা
ক্স চাষির আর্থিক সঙ্গতি
ক্স উচ্চ খাদ্য পরিবর্তন হার
ক্স উপকরণের আকার
ক্স উপকরণ সংরণের মেয়াদ
খাদ্যের পুষ্টিমান নির্ধারণঃ
খাদ্য প্রস্তুতির জন্য নির্বাচিত উপকরণসমূহের পুষ্টি উপাদান আমিষ সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও ব্যয়বহুল। এ জন্য মাছের খাদ্য তৈরির সময় শুধুমাত্র আমিষের মাত্রা হিসাব করা হয়। মাছের খাদ্যে আমিষের মাত্রা নিরুপণের জন্য কৌনিক সমীকরণ পদ্ধতি বহুল প্রচলিত। এই পদ্ধতিটি Pearsons Sqare Method (বর্গ পদ্ধতি) নামে পরিচিত।
পিয়ারসন্স বর্গ পদ্ধতিঃ
ধরা যাক, ফিসমিলে ৬০% ও চালের কূঁড়া ৮% আমিষ আছে। এ দুইটি উপকরণ ব্যবহার করে খাদ্য তৈরি করতে হবে এবং প্রস্তুতকৃত খাদ্যে আমিষের মাত্রা হবে ৩০%।
ক্স একটি বর্গ আঁকতে হবে এবং প্রত্যাশিত আমিষের মাত্রা (৩০%) বর্গের মাঝখানে লিখতে হবে।
ক্স বর্গের বাম পার্শ্বে দু’টি উপকরণের নাম তাদের আমিষের মাত্রাসহ লিখতে হবে।
ক্স প্রত্যাশিত আমিষের মাত্রা থেকে উপকরণের আমিষের মাত্রা বিয়োগ করতে হবে।
ক্স বিয়োগ ফল বর্গের উপকরণের বিপরীত কোণে অর্থাৎ বর্গের কর্ণের শেষে লিখতে হবে।
ক্স বিয়োগ ফল ঋণাত্বক হলে তা বিবেচনা করার প্রয়োজন নেই।
ক্স বর্গের ডানদিকে সংখ্যাগুলোকে যোগ করতে হবে।
ক্স অতঃপর ডান দিকের যোগফল দিয়ে শতকরা হার বের করতে হবে।
এখানে,
ফিশমিল = ২২/৫২ x ১০০ = ৪২.৩১ অংশ
চালের কুঁড়া = ৩০/৫২ x ১০০ = ৫৭.৬৯ অংশ
অতএব, খাদ্য উপকরণের পরিমাণ
ফিশমিল = ৪২.৩১ গ্রাম
চালের কুঁড়া = ৫৭.৬৯ গ্রাম
—————————————-
মোট = ১০০ গ্রাম
এখন, প্রত্যাশিত আমিষের সঠিক আছে কিনা, তা যাচাই করার জন্য নির্ণিত উপকণের সাথে তাদের নিজস্ব আমিষের মাত্রা/হার পূরণ দিয়ে যোগ করতে হবে।
ফিশমিল = ৪২.৩১ x ০.৬০ = ২৫.৩৯ গ্রাম
চালের কুঁড়া = ৫৭.৬৯ x ০.০৮ = ৪.৬১ গ্রাম
——————————————————-
মোট = ৩০ গ্রাম আমিষ
সম্পূরক খাদ্য তৈরীঃ
সে সকল দ্রব্য মাছকে খাওয়ানোর জন্য বাহির থেকে পুকুরে সরবরাহ করা হয়, যাহা মাছের য়পূরণ, দৈহিক বৃদ্ধি সাধনে কাজ করে এবং মাছের রোগ প্রতিরোধ ও প্রজনন সমতা লাভে সহায়ক ভুমিকা রাখে, সেসকল দ্রব্যকে মাছের সম্পুরক খাদ্য বলা হয়। সম্পুরক খাবার দুইভাবে প্রস্তুত করা যেতে পারে।
ক) বাণিজ্যিক খাদ্যঃ বর্তমানে বেসরকারি উদ্যোগে মাছের খাবার বাণিজ্যিকভাবে প্রস্তুত করার জন্য বহু খাদ্য মিল স্থাপিত হয়েছে। এসকল কারখানায় মাছের বয়সের ওপর ভিত্তি করে বিভিন্ন মানের খাবার প্রস্তুত করা হচ্ছে। মাছ চাষিগণ তার চাহিদা অনুযায়ী বাজার থেকে বিভিন্ন পুষ্টিমানের ও দামের খাদ্য সংগ্রহ করে সহজেই পুকুরে প্রয়োগ করতে পারেন। কারখানায় প্রস্তুত পিলেট খাবার পানিতে সহজে গলে না, তাতে খাদ্যের অপচয় কম হয় এবং পানি সহজে নষ্ট হয় না। বানিজ্যিকভাবে পিলেট খাবারে মাছের প্রজাতি বয়সভেদে পুষ্টি উপাদান আনুপাতিক হারে সংশ্লেষ থাকায় খাদ্য পরিবর্তন হার (Food Conversion Ratio) বেশি হয় অর্থাৎ তুলনামূলক স্বল্প খাদ্য প্রয়োগে অধিক উৎপাদন নিশ্চিত করা যায়।
খ) খামারে প্রস্তুতকৃত সম্পূরক খাদ্যঃ বাজারের পিলেট খাবারের পুষ্টিমান ঘোষনার সাথে সব সময় ঠিক থাকে না। মাছের বর্ধন ভাল পেতে হলে প্রয়োজনীয় খাদ্যে উপকরণসমূহ বাজার থেকে কিনে নিজস্ব পিলেট মেশিন দ্বারা খাদ্য তৈরি করা সবচেয়ে নিরাপদ। খামারে দুভাবে খাদ্য প্রস্তুত করা যায়। বিভিন্ন ধরণের খাদ্য উপকরণ প্রয়োজন মাফিক একত্রে ভালোভাবে মিশিয়ে নিজ হাতেই খাদ্য প্রস্তুত করে পুকুরে প্রয়োগ করা যায় অথবা খাদ্য প্রস্তুত মেশিন এর সাহায্যে বিভিন্ন উপকরণ পরিমাণমত মিশিয়ে চাহিদা অণুযায়ী দানাদার সম্পুরক খাদ্য তৈরি করা যায়। খামারে প্রস্তুত সম্পুরক খাদ্য টাটকা (Fresh) হওয়ায় মাছের খাদ্য গ্রহণ প্রবণতা বৃদ্ধি পায়। এছাড়া খাবারে ছত্রাক, মোল্ড বা অন্যান্য পরজীবি দ্বারা আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনাও কম থাকে। কৃত্রিম দানাদার খাবারে ১০% এর অধিক জ্বলীয় অংশ থাকলে ছত্রাক বা মোল্ড দ্বারা সক্রামিত হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়। মাছের কাঙ্খিত উৎপাদন নিশ্চিতকল্পে খাদ্য ব্যবস্থাপনা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। অধিকন্তু বানিজ্যিক মৎস্য চাষে ৭০-৭৫% ব্যয়ই খাদ্য খাতে হয়ে থাকে। এক্ষেত্রে কৈ, শিং ও মাগুর মাছের জন্য নিম্নহারে খাদ্যের উপকরণ মিশিয়ে স্বল্প মূল্যে কিন্তু ভালো মানের খাদ্য প্রস্তুত করা যেতে পারে।
উপকরণ শতকরা হার
ফিশমিল ২০
সোয়বিন চূর্ণ ৮
অটোকুড়া ৩০
ভুট্টাচূর্ণ ৫
গমের ভুসি ১২
চিটাগুড়/রাব ৫
সরিষার খৈল ২০
ভিটামিন প্রিমিক্স ১ গ্রাম/কেজি
খাদ্য প্রস্তুতের ২৪ খন্টা পূর্বেই সরিষার খৈল পরিমাণমত পানিতে ভিজিয়ে রাখতে হবে। অতপর অন্য সকল উপকরণের সাথে ভালোভাবে মিশিয়ে এমন ভাবে পানি মিশাতে হবে যেন খাবার অনেকটা শুকনা খাবারের মত হয়।
পুকুরে খাদ্য প্রয়োগ মাত্রাঃ
মাছের খাদ্য গ্রহণ মাত্রা নির্ভর করে পানির ভৌত ও রাসায়নিক গুণাবলীর অনুকূল অবস্থার ওপর। তাপমাত্রা বাড়লে মাছের বিপাকীয় কার্যক্রমের হার বেড়ে যায়। ফলে খাদ্য চাহিদা বৃদ্ধি পায়। একইভাবে পানির তাপমাত্রা কমে গেলে খাদ্য চাহিদাও কমে যায়। মাছের খাদ্য গ্রহণ ও বিপাকের জন্য তাপমাত্রা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অনুঘটক হিসেবে কাজ করে। যেমনঃ প্রতি তাপমাত্রা ১০০সে. বৃদ্ধির সাথে মাছের খাদ্য গ্রহণ মাত্রা দ্বিগুণ হয়ে যায়। তদ্রƒপ পানির তাপমাত্রা পানির ১০০সে. কমে গেলে মাছের খাদ্য গ্রহণ স্পৃহা অর্ধেকে নেমে আসে। পিএইচ ৭.০-৮.৫ ও পানিতে দ্রবিভূত অক্সিজেনের মাত্রা বাড়লে মাছের খাদ্য চাহিদা বৃদ্ধি পায়। তা’ছাড়া ছোট অবস্থায় মাছ তুলনামূলক বেশি খাবার গ্রহণ করে থাকে।
কৈ, শিং ও মাগুর মাছের দৈহিক ওজনের সাথে খাদ্য প্রয়োগের মাত্রা
মাছের গড় ওজন (গ্রাম) দৈনিক খাদ্যের পরিমাণ (%)
১-৩ ১৫-২০
৪-১০ ১২-১৫
১১-৫০ ৮-১০
৫১-১০০ ৫-৭
>১০১ ৩-৫
নমুনায়ন ও খাদ্য সমন্বয়ঃ
নমুনাকরণের মাধ্যমে পুকুরের মোট মাছের জীবভর (Biomass) হিসাব করে খাদ্য প্রয়োগের পরিমাণ নির্ধারণ করতে হবে। নমুনা সংগ্রহের ক্ষেত্রে একটি ঝাঁকি জাল ব্যবহার করা যেতে পারে এবং মজুদ মাছের ৫-১০% নমুনা সংগ্রহ করা উত্তম। ধৃত মাছের গড় ওজন হিসাব করে এবং মাছের বাঁচার হার ৯০% বিবেচনায় এনে মোট জীবভর নির্ণয় করতে হবে। কৈ, শিং ও মাগুর মাছ চাষের ক্ষেত্রে দৈনিক প্রয়োজনীয় খাবার সমান ৩ ভাগ করে সকাল, দুপুর ও বিকালে প্রয়োগ করতে হবে। মাছের আকার ৩০ গ্রাম হলে মোট খাদ্যকে দুই ভাগ করে সকাল ও বিকালে প্রয়োগ করতে হবে। প্রতি ১৫ দিন অন্তর মাছের নমুনায়ন করে মাছের জীবভর পরিমাপ করে খাদ্য প্রয়োগ মাত্রা সমন্বয় করতে হবে।
পুকুরে খাদ্য প্রয়োগ পদ্ধতিঃ
নিম্নরূপে পুকুরে খাদ্য প্রয়োগ করা যেতে পারে
ক্স সমস্ত পুকুরে সমান ভাবে ছিটিয়ে
ক্স নির্ধারিত স্থানে
ক্স খাদ্যদানীতে প্রয়োগ করা। খাদ্যদানীর সংখ্যা পুকুরে মজুদকৃত মাছের সংখ্যা ও আকারের ওপর ভিত্তি করে নির্ণয় করতে হবে।
পুকুরে খাদ্য প্রয়োগের সময় নিম্নে উল্লেখিত বিষয়াবলী অনুসরণ করা প্রয়োজনঃ–
ক্স খাদ্য প্রয়োগের জন্য সুবিধামত যে কোন একটি বা দুটির মিশ্র পদ্ধতি অনুসরণ করা যেতে পারে। কারণ বিদ্যমান সকল পদ্ধতির কিছু সুবিধা এবং অসুবিধা রয়েছে।
ক্স খাদ্য প্রতিদিন নির্দিষ্ট সময়ে, নির্দিষ্ট স্থানে পরিমিত পরিমাণ প্রয়োগ করতে হবে
ক্স পানি অতিরিক্ত সবুজ বা দূষিত হয়ে পড়লে বা বৃষ্টি হলে খাদ্য দেয়া কমাতে হবে
ক্স মাছ যে কোন কারণে পিড়ন (Stress) অবস্থার সম্মূখীন সৃষ্টি হলে খাদ্য প্রয়োগ কমিয়ে দিতে হবে এবং প্রয়োজনে বন্ধ করে দিতে হবে। অন্যথায় খাদ্য অপচয় হয়ে পরিবেশ বিনষ্ট করবে।
কৈ, শিং ও মাগুর মাছ চাষের পুকুরের পানি ব্যবস্থাপনাঃ
কৈ, শিং ও মাগুর মাছ চাষের ক্ষেত্রে প্রতিদিন নিয়মিত হারে আমিষ সমৃদ্ধ খাবার প্রয়োগ করায় মাছের মলমুত্র এবং খাবারের উচ্ছিষ্ট পানিতে পঁচে পানির নাইট্রোজেন ঘটিত জৈব পদার্থের উপস্থিতি বেড়ে যায় ফলে মাছ নানা প্রকার সমস্যার সম্মুখিন হয়ে থাকে। অধিক পঁচনশীল জৈব দ্রব্য পুকুরে প্রয়োগ করাই সমীচীন। পুকুরে জৈব উপাদানের বৃদ্ধির কারণে প্ল্যাঙ্কটনিক ব্লুমের সৃষ্টি হতে পারে এবং এক পর্যায়ে প্ল্যাঙ্কটনের যথাযথ পরিবেশ বিঘ্নিত হয় এবং প্ল্যাঙ্কটনের অপমৃত্যু ঘটায়, ফলশ্র“তিতে পুকুরের পানির সার্বিক পরিবেশের মারাত্বক বিপর্যয় ঘটে এবং মাছের মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়ায়। এরূপ পরিবেশে প্রথমে মাছের খাদ্য গ্রহণ হার কমে যায়, মাছের বৃদ্ধি থেমে যায় এবং এক পর্যায়ে বিপুল হারে মাছ মারা যায়। এরূপ পরিবেশ যাতে না হয় সেজন্যে পানির রং এর অবস্থা অনুযায়ী মাঝে মধ্যে পানি দেয়া যেতে পারে, অথবা পুকুর থেকে কিছু পানি বের করে দিয়ে পুনরায় পানি সংযোগ করা যেতে পারে। এসব মাছের চাষ নিরাপদ রাখার জন্য সময়ে সময়ে প্রতি শতকে ২৫০ গ্রাম হারে খাদ্য লবণ ও চুন প্রয়োগ করা যেতে পারে। পুকুরের পানির পরিবেশ ভালো রাখার জন্য বর্তমানে বাজারে নানা ধরণের জিওলাইট ও অনুজীব নাশক পাওয়া যায়, যাহা প্রয়োগে সুফল পাওয়া যাচ্ছে।
কৈ, শিং ও মাগুর মাছ চাষে অন্যান্য ঝুঁকিঃ
এসব মাছ চাষে ঋতুভিত্তিক কিছু ঝুঁকি থাকে। তাই সঠিক ব্যবস্থাপনা না নিলে তিগ্রস্থ হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। এমনকি অনেক সময় সমস্ত চাষ ব্যবস্থা হুমকির সম্মূখে পড়তে পারে।
ক) বর্ষাকালীন ঝুঁকিঃ বর্ষাকালীন অতিবৃষ্টি বা বন্যায় পুকুরের পাঁড় ভেসে গিয়ে চাষকৃত মাছ বেরিয়ে যেতে পারে। হালকা গুড়িগুড়ি বৃষ্টিতে পরিপক্ক কৈ ও মাগুর মাছ পানির স্রোতের ওপর ভর করে পুকুরের পাড় বেয়ে অন্যত্র চলে যেতে পারে। এ কারণে পুকুরের পাড়ে চারিদিকে বাঁশের বানা বা বেড়া অথবা প্লাস্টিক নেটের সাহায্যে ১.৫ ফুট উচু করে বেষ্টনির ব্যবস্থা করতে হবে।
খ) শুষ্ক মৌসুমের ঝুঁকিঃ শুষ্ক মৌসুমে পুকুরের পানি শুকিয়ে পানির গভীরতা কমে পানির ঘনত্ব বেড়ে মাছের দৈহিক বৃদ্ধি বাঁধা গ্রস্ত হতে পারে। এতে পানির তাপমাত্রা বেড়ে পানিতে দ্রবিভূত অক্সিজেন স্বল্পতার সৃষ্টি হতে পারে। পানি সরবরাহের মাধ্যমে পানির গভীরতা বাড়িয়ে পুকুরের প্রতিবেশ সহায়ক করতে হবে।
গ) শীতকালীন ঝুঁকিঃ শীতে (১৫০ সে: তাপের নীচে) বিশেষ করে কৈ মাছ চাষে রোগের প্রাদূর্ভাব বেশি হয়, সে জন্য শীতের ২-৩ মাস কৈ মাছ চাষ না করাই ভাল। তবে এ সময়ে মাছ বা পোনা সংরণের জন্য পানির তাপমাত্রা বাড়িয়ে রাখার নিমিত্ত প্রতি দিন ভোরে গভীর নলকূপ-এর পানি দেয়া যেতে পারে।
ঘ) ক্ষতিকর গ্যাসঃ খাদ্যের অবশিষ্টাংশ এবং মাছের মলমূত্রের কারণে পুকুরের তলদেশে তিকর গ্যাস জমে বুদবুদের সৃষ্টি করতে পারে এবং পানিতে দুর্গন্ধের সৃষ্টি হতে পারে। পুকুরের তলদেশে জমে থাকা তিকর গ্যাস অপসারণের জন্য ২-৩ দিন পর পর দুপুরের সময় পানিতে নেমে তলদেশ আলোড়িত করার ব্যবস্থা করতে হবে। কাজটি হরÍা টেনেও করা যায়। এেেত্র শতকে ২৫০ গ্রাম হারে চুন প্রয়োগ করতে হবে। তিকর গ্যাসের উপস্থিতির সমস্যা প্রকট আকাররূপে দেখা দিলে জিওনেক্স প্রয়োগে ভালো ফলাফল পাওয়া যায়।
ঙ) মাছ চুরিঃ এটা একটি সাধারণ সমস্যা বা সামাজিক ঝুঁকি। পুকুরের মাছ বড় হলে এ ঝুঁকি বেড়ে যায়। তাই বড় মাছগুলো আহরণ করলে চুির হওয়ার সম্বাবনা কমে যায়। এ ছাড়াও মাছ চাষিকে সমাজের অন্যদের সাথে উত্তম সম্পর্ক বজায় রাখতে হবে এবং ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও সামাজিক দ্বন্দ্ব এড়াতে হবে। উৎপাদিত মাছ থেকে পুকুরের পার্শ্বে বসবাসকারীদের সৌজন্যমূলক কিছু মাছ বিতরণ করা যেতে পারে।
মাছ আহরণ ও বাজারজাতকরণঃ
মাছ আহরণঃ মাছ চাষের পদ্ধতি সঠিকভাবে পরিচালিত হলে প্রজাতি ভেদে চাষের ১০০-১৪০ দিনে মাছ বাজারজাত করণের উপযোগী হয় এবং এসময়ে মাছের গড় ওজন ৪০-১১০ গ্রাম হয়ে থাকে। মাছের আকার, ওজন, মাছের বাজার দর, চুরিসহ অন্যান্য ঝুঁকি এবং বিশেষ করে পুকুরে মাছের ধারণমতা (Carrying Capacity) বিবেচনায় রেখে মাছ আহরণ ও বাজারজাতকরণের সিদ্ধান্ত নিতে হবে। বাজারজাতকরণের নিমিত্ত আহরিত মাছের গুণগত মান অধিক সময় ভালো রাখার জন্য মাছ ধরার ১ দিন পূর্বে খাবার প্রয়োগ বন্ধ রাখা উচিত। মাছ চাষের পুকুরে অধিক ঘনত্বে মাছ থাকলে মাছ বাজারজাতকরণের পূর্বের দিন জাল টেনে মাছ ধরে ছেড়ে দিতে হবে, এর ফলে বাজারজাত করার সময় মাছের মৃত্যু হার কমে যাবে।
মাছের বাজার দরঃ মাছের বাজার দর বিভিন্ন এলাকায় ও ঋতুতে কম বেশি হয়ে থাকে। বাজার চাহিদা ও মূল্যের প্রতি খেয়াল রেখে মাছ বাজারজাত করা উচিত। মাছের বাজার দর ভালো পাওয়ার জন্য মাছ ধরার আগেই দেশের বড় বাজারসমূহে সম্ভব হলে রপ্তানীকারক প্রতিষ্ঠান বা মৎস্য প্রক্রিয়াজাতকরণ কারখানায় যোগাযোগ স্থাপন করে বাজার দর যাচাই এর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। জীবন্ত মাছ ছোট বড় বাছাই করে (Grading) বাজারসমূহে পাঠানোর ব্যবস্থা করা গেলে অধিক মূল্য পাওয়া যায়।
আহরণ পূর্বে করণীয় কাজঃ
মাছ আহরণের সিদ্ধান্ত গ্রহণের পূর্বে নিম্নে উল্লেখিত বিয়ষসমূহ বিবেচনা করা প্রয়োজনঃ
বাজার দর যাচাই
ক্রেতা নির্ধারণ
জেলে ও জালের ব্যবস্থা
পরিবহন ব্যবস্থা
পুকুরে বিদ্যমান জলজ আগাছা ও ডালপালা (যদি থাকে) অপসারণ
মাছ পরিমাপের জন্য উপযুক্ত পরিমাপক যন্ত্রের ব্যবস্থা
মাছ জীবন্ত অবস্থায় বাজারজাত করার জন্য কন্টেনার (ড্রাম) এর ব্যবস্থা
মাছ আহরণ করে প্রাথমিক ভাবে জীবন্ত সংরণের জন্য প্রয়োজনীয় নেটের হাফা সংগ্রহ
মাছ প্যাকিং ও পরিবহনকালীন সংরণের জন্য পাত্র এবং বরফ সংগ্রহ ।
কৈ, শিং ও মাগুর মাছ চাষের আর্থিক বিশ্লেষণঃ
(ক) এক একরের একটি পুকুরে উপরে উল্লেখিত পদ্ধতিতে কৈ মাছ চাষে সম্ভাব্য উৎপাদন ও আয়-ব্যয়ের হিসাবঃ-
ব্যয়ের হিসাবঃ পুকুর সংস্কার/ভাড়া (৬ মাসের জন্য), কৈ মাছের পোনা ৪০,০০০টি (নার্সারিতে লালনের পর ৩০,০০০টি প্রাপ্তি নিশ্চিত করার জন্য), সিলভার/কাতল ১৫০টি (৬-৭” আকারের), চুন ২৫০ কেজি, মাছের খাদ্য (প্রায় ৩৫০০ কেজি; FCR=১.০০ ঃ ২.১৯), পারিবারিক শ্রম, শ্রমিক মজুরী, পরিবহন খরচ ও অন্যান্য খরচ বাবদ মোট ১,৮৩,০০০.০০ টাকা।
আয়ের হিসাবঃ কৈ মাছ বিক্রয় (বাঁচার হার ৮০% এবং ১৫টিতে কেজি ধরে এবং বাজার দর @ ১৫০/- হিসাব), সিলভার/কাতল মাছ বিক্রয় ২০০ কেজি (প্রায়) বাবদ মোট আয় ২,৫১,০০০.০০ টাকা।
নিট লাভ = (২,৫১,০০০.০০ Ñ ১,৮৩,০০০.০০)= ৬৮,০০০.০০ টাকা
(খ) এক একরের একটি পুকুরে উপরে উল্লেখিত পদ্ধতিতে শিং মাছ চাষে সম্ভাব্য উৎপাদন ও আয়-ব্যয়ের হিসাবঃ-
ব্যয়ের হিসাবঃ পুকুর সংস্কার/ভাড়া (৬ মাসের জন্য), শিং ও কৈ মাছের পোনা ৪০,০০০টি {নার্সারিতে লালনের পর ৩০,০০০টি (শিং ২০,০০০টি + কৈ ১০,০০০ টি) প্রাপ্তি নিশ্চিত করার জন্য}, সিলভার/কাতল ১০০টি (৬-৭” আকারের), চুন ২৫০ কেজি, মাছের খাদ্য (প্রায় ৩০০০ কেজি; FCR=১.০০ ঃ ২.৭৪), পারিবারিক শ্রম, শ্রমিক মজুরী, অন্যান্য, পরিবহন খরচ বাবদ মোট খরচ = ১,৯০,০০০.০০ টাকা।
আয়ের হিসাবঃ শিং মাছ বিক্রয় (বাঁচার হার ৭০% এবং ২৫টিতে কেজি ধরে এবং বাজার দর @ ৩০০/- হিসাব), কৈ মাছ বিক্রয় (বাঁচার হার ৮০% এবং ১৫টিতে কেজি ধরে এবং বাজার দর @ ১৫০/- হিসাব), সিলভার/কাতলা মাছ বিক্রয় (১০০ কেজি) বাবদ মোট আয় = ২,৮১,৫০০.০০ টাকা।
নিট লাভ = (২,৮১,৫০০.০০ Ñ ১,৯০,০০০.০০)= ৯১,৫০০.০০ টাকা
(গ) এক একরের একটি পুকুরে উপরে উল্লেখিত পদ্ধতিতে মাগুর মাছ চাষে সম্ভাব্য উৎপাদন ও আয়-ব্যয়ের হিসাবঃ-
ব্যয়ের হিসাবঃ পুকুর সংস্কার/ভাড়া (৬ মাসের জন্য), মাগুর মাছের পোনা ৩৫,০০০টি }নার্সারিতে লালনের পর ২৫,০০০টি (মাগুর ১৫,০০০টি + কৈ ১০,০০০ টি) প্রাপ্তি নিশ্চিত করার জন্য}, সিলভার/কাতল ১০০টি (৬-৭” আকারের), চুন ২৫০ কেজি, মাছের খাদ্য (প্রায় ৩০০০ কেজি; FCR=১.০০ ঃ ২.৩৪), পারিবারিক শ্রম, শ্রমিক মজুরী, অন্যান্য, পরিবহন খরচ বাবদ মোট খরচ = ১,৭০,০০০.০০ টাকা।
আয়ের হিসাবঃ মাগুর মাছ বিক্রয় (বাঁচার হার ৭০% এবং ১৪টিতে কেজি ধরে এবং বাজার দর @ ২০০/- হিসাব), কৈ মাছ বিক্রয় (বাঁচার হার ৮০% এবং ১৫টিতে কেজি ধরে এবং বাজার দর @ ১৫০/- হিসাব), সিলভার/কাতল মাছ বিক্রয় (১০০ কেজি) বাবদ মোট আয় = ২,২৩,০০০.০০ টাকা।
নিট লাভ = (২,২৩,০০০.০০ Ñ ১,৭০,০০০.০০) = ৫৩,০০০.০০ টাকা
উপসংহারঃ
একবার কৈ, শিং ও মাগুর মাছ চাষের পর ঐ একই পুকুরে মাছ আহরণের পরপরই আবার এসকল মাছ চাষ করা উচিত নয়। এসব মাছ চাষের পর পর্যায়ক্রমে (Crop Rotation) অন্য মাছ যেমন তেলাপিয়া বা রুইজাতীয় মাছের মিশ্রচাষ করা যেতে পারে। চাষের পুকুরের তলায় জমে থাকা কালো কাদা (Sludge) তুলে সব্জির ক্ষেত্রে, ফল বা ফুলের বাগানে দেয়া যেতে পারে। চীন দেশে Ecological Farming Concept-G Sludge ব্যবহার করে সাথী ফসল হিসেবে সব্জী, ফুল ও ফল চাষে ব্যাপক সফলতা অর্জন করেছে। আমাদের দেশের সীমিত সম্পদের সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করে অর্থনৈতিক স্বাবলম্বিতা অর্জনের লক্ষ্যে এব্যবস্থা প্রবর্তন করতে হবে। এছাড়া পরিশেগত উৎকর্ষতা বিধানেও তা ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে সম হবে। কৈ, শিং ও মাগুর মাছ সু-স্বাদু জনপ্রিয় মাছ এবং এসব মাছের ব্যাপক সম্ভাবনা রয়েছে। বিদেশেও এসব মাছের চাহিদা প্রচুর এবং ইতোমধ্যে রপ্তানী শুরু হয়েছে। মাছটি চাষের আধুনিক প্রযুক্তি সম্প্রসারণের কার্যকরী পদপে গ্রহণ করা গেলে প্রাণিজ আমিষের চাহিদা পূরণ, কর্মসংস্থান সৃষ্টিসহ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন সম্ভব হবে।
তথ্যসূত্রঃ মৎস্য অধিদপ্তর, পাণিসম্পদ মন্ত্রনালয়, ঢাকা।