বাকৃবি গবেষকের সফলতাঃ বিপন্ন কুচিয়ার প্রজননে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি

[মো. আব্দুর রহমান, বাকৃবি] বিপন্ন প্রজাতির দেশীয় কুচিয়া মাছের প্রজনন ও পোনা উৎপাদনের বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি উদ্ভাবনে সফলতা পেয়েছেন বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাকৃবি) মাৎস্য বিজ্ঞান অনুষদের প্রফেসর ড. হারুনুর রশীদ।
অতীতে দেশীর বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান কুচিয়ার প্রজনন ও পোনা উৎপাদনে সফল হলেও পোনার খাবার ব্যবস্থাপনা করে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে উৎপাদনে কোনো পদ্ধতি উদ্ভাবিত হয়নি। তবে সম্প্রতী কুচিয়ার প্রজনন, পোনা উৎপাদন এবং পোনার খাবার ব্যবস্থাপনা করে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে উৎপাদনের বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি উদ্ভাবনে এক ধাপ সফলতা পেয়েছেন বলে দাবি করেছেন প্রফেসর ড. হারুনুর রশীদ।
কুচিয়া মাছ দেখতে বাইম মাছের মতোই। যা খেতে খুবই সুস্বাদু। উপজাতিদের কাছে কুচিয়া মাছ খুবই জনপ্রিয় খাবার। কুচিয়া মাছ দু’প্রকার। দেশীয় কুচিয়া মাছের বৈজ্ঞানিক নাম ‘মনোপটেরাস কুচিয়া’ আর চীনসহ বিভিন্ন দেশে যে কুচিয়া মাছ পাওয়া যায় তার বৈজ্ঞনিক নাম ‘মনোপটেরাস এলভাস’।  দেশীয় একটি কুচিয়ার ওজন সাধারণত ৩০০ থেকে ১৫০০ গ্রাম পর্যন্ত হয়। চায়না প্রজাতির ‘মনোপটেরাস এলভাস’ কুচিয়ার ওজন সাধারণত ১০০০ গ্রামের বেশি হয় না। ফলে বিদেশে বাংলাদেশি কুচিয়ার চাহিদা দিন দিন বাড়ছে। প্রতিবছরই বাংলাদেশের বিভিন্ন খাল-বিল থেকে আহরিত কুচিয়া সাধারণত দক্ষিণ কোরিয়া, চীন, কম্বোডিয়া, থাইল্যান্ড, লাওস, ভিয়েতনাম ও ইন্দোনেশিয়ায় রপ্তানি হয়। ২০১০-১১ অর্থবছরে ২৭ লাখ ডলারের কুচিয়া রপ্তানি হয়েছে। গত অর্থবছরে যা ছিল প্রায় এক কোটি ডলার এর মতো।

Cuchia breeding photosদক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন দেশে কুচিয়ার ব্যাপক চাহিদা থাকায় এ দেশের ময়মনসিংহ, শেরপুরের ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী, বগুড়াসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে প্রকৃতি থেকে প্রজননক্ষম মা কুচিয়া সংগ্রহ করে রপ্তানি করা হচ্ছে। ফলে দিন দিন প্রকৃতি থেকে কমে যাচ্ছে কুচিয়া মাছ। ২০০০ সালের দিকে কুচিয়াকে বাংলাদেশের বিপন্ন মাছের প্রজাতি হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে।
গবেষণা বিষয়ে ড. হারুন বলেন, ‘কুচিয়ার বাণিজ্যিক ভিত্তিতে চাষের জন্য কৃত্রিম পদ্ধতিতে পোনা উৎপাদনের বিকল্প নেই। এসব বিষয়কে সামনে রেখে ২০১৩ সাল থেকে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিলের (বিএআরসি) অর্থায়নে আমরা গবেষণা শুরু করি। গবেষণার প্রথম দিকে ময়মনসিংহের বিভিন্ন এলাকা থেকে কুচিয়া সংগ্রহ করে কৃত্রিম প্রজননের জন্য বিভিন্ন ধরনের প্রজনন হরমোন প্রয়োগ করি। কিন্তু অন্য সব মাছের মতো কুচিয়ায় প্রজনন হরমোন দিয়ে কৃত্রিম প্রজনন করানো সম্ভব হয়নি। পরে আমরা গবেষণা পুকুরে কুচিয়ার প্রজননের জন্য উপযোগী কৃত্রিম পরিবেশ তৈরি করে পোনা উৎপাদনে সফল হই।’
গবেষক ড. রশিদ বলেন, ‘কুচিয়ার পোনা উৎপাদনের থেকেও কঠিন কাজ হলো পোনাকে বাঁচিয়ে রাখা। অর্থাৎ পোনা উৎপাদনের তিন দিন পর থেকে সাধারণত পোনাকে খাবার সরবরাহ করতে হয়। কিন্তু কুচিয়ার পোনা আমাদের প্রচলিত খাবার গ্রহণ না করায় পোনাকে বাঁচিয়ে রাখা সম্ভব হচ্ছিল না। ফলে কুচিয়ার বাণিজ্যিক পোনা উৎপাদনের বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল পোনার খাবার। তবে আমরা উৎপাদিত পোনাকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য বিভিন্ন ধরনের খাবার নির্ণয় করতে সক্ষম হয়েছি। ওইসব খাবার ব্যবহার করে আমরা পোনাকে বাঁচিয়ে রাখতে পেরেছি। ওইসব খাবারের মধ্যে কোনটিতে সব থেকে ভালো ফল পাওয়া যায় সে বিষয়ে এখন গবেষণা চলছে। আশা করছি, আমরা খাবার বিষয়টি নির্ধারণ করতে পারলে কুচিয়ার বাণিজ্যিক ভিত্তিতে পোনা উৎপাদন করা সম্ভব হবে।’
ড. হারুন আরো বলেন, ‘কুচিয়া মাছকে প্রচলিত প্রজনন হরমোন দিয়ে উদ্দীপ্ত করে কৃত্রিম প্রজনন করা সম্ভব হয়নি। চীন-ভিয়েতনাম তাদের কুচিয়া প্রজাতিকে কৃত্রিম প্রজনন করানোর জন্য গবেষণা করে প্রজনন হরমোন উদ্ভাবন করেছে। ফলে তারা বাণিজ্যিক ভিত্তিতে ব্যাপক হারে পোনা উৎপাদন করতে পারছে। আমাদের দেশীয় কুচিয়ার জন্য সে রকম একটি প্রজনন হরমোন উদ্ভাবন করতে পারলে আমরাও বাণিজ্যিক ভিত্তিতে পোনা উৎপাদন করতে পারবো। সরকারের সহযোগিতা পেলে আমরা প্রচলিত প্রজনন হরমোন উদ্ভাবন করে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের পাশাপাশি কুচিয়ার বিপন্নতাকে রক্ষা করতে পারবো।’
এ প্রকল্পে পি-এইচ.ডি. গবেষক হিসেবে কাজ করছেন বগুড়া পল্লী উন্নয়ন একডেমীর সহকারী পরিচালক জনাব মাকসুদ আলম খান। জনাব মাকসুদের পি-এইচ.ডি. গবেষণা তত্ত্বাবধায়ক ড. হারুন বলেন যে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিলের অর্থায়নে চার বছর ধরে পরিচালিত এ প্রকল্পের চতুর্থ বছরে এসে জনাব মাকসুদের হাতে এই সফলতা পাওয়া গেল।


Abdur Rahman Journalist BAU

 

 

 

মো. আব্দুর রহমান, ছাত্র ও সাংবাদিক, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহ-২২০২।

Leave a Comment

You must be logged in to post a comment.