বিনাধান-৭ চাষ পদ্ধতি
ধান বাংলাদেশের প্রধান খাদ্যশস্য। এ দেশে আউশ, আমন ও বোরো এ তিন মৌসুমে ধানের আবাদ হয। এ তিন মৌসুমের মধ্যে আমন মৌসুমে সবচেয়ে বেশি জমিতে ধানের আবাদ হয়। আমাদের দেশে আমন ধানের গড় ফলন হেক্টর প্রতি মাত্র ২.৫-৩ টন অর্থাৎ বিঘা প্রতি মাত্র ৮-১০ মণ। বিনা কর্তৃক উদ্ভাবিত উচ্চফলনশীল বিনাধান-৭ জাত উন্নত পদ্ধতিতে চাষ করে ফলন প্রায় হেক্টর প্রতি ৪.৫-৫.৫ টন অর্থাৎ বিঘা প্রতি ১৫-১৮ মণ পাওয়া যায়।
বিনাধান-৭ বৈশিষ্ট্যঃ
– এটি উচ্চফলনশীল ও উন্নত গুণসম্পন্ন রোপা আমন জাত।
– জীবনকাল মাত্র ১১০-১১৫ দিন। আগাম পাকে বিধায় এ ধান কাটার পর সহজেই আলু, গম, সরিষা ও অন্যান্য রবি ফসল আবাদ করা যায়।
– চাল লম্বা, চিকন ও খেতে সুস্বাদু। তাই বাজারমূল্য বেশি ও রপ্তানির উপযোগী।
– ভাত ঝরঝরে হয় ও দীর্ঘক্ষণ ভাল থাকে, নষ্ট হয় না।
– এ জাতে রোগবালাই ও পোকামাকড়ের আক্রমণ তুলনামূলকভাবে কম হয়।
– জীবনকাল কম বিধায় এ ধান আবাদ করলে একই জমিতে বছরে ৩-৪টি ফসল আবাদ করা যায়।
কেমন জমিতে বিনাধান-৭ চাষ করতে হবেঃ
বেলে দোআঁশ ও এঁটেল দোআঁশ জমিতে এ ধান ভালো হয়। বেশি নিচু জমি ছাড়া প্রায় সব ধরনের জমিতে এ ধান আবাদ করা যায়।
বীজতলা তৈরিঃ
জুন মাসের শেষ সপ্তাহ হতে জুলাই মাসের শেষ সপ্তাহ পর্যন্ত বীজতলায় বীজ ফেলা যায়। ৪-৫ টি চাষ ও মই দিয়ে বীজতলা তৈরি করতে হবে। বীজতলা শুকনা ও কাদা করে তৈরি করা যায়। এক বিঘা জমি আবাদ করতে ৩-৪ কেজি বীজ দরকার হয়।
চারার বয়স ও রোপণ পদ্ধতিঃ
জুলাই মাসের শেষ সপ্তাহ হতে আগষ্ট মাসের শেষ সপ্তাহের মধ্যে ২০-২৫ দিন বয়সের চারা রোপণ করতে হবে। প্রতি গোছায় ৩-৪ টি সুস্থ ও সবল চারা দিতে হবে। সারি করে রোপণ করলে ৮ ইঞ্চি দূরে দূরে সারি ও ৬ ইঞ্চি দূরে দূরে গোছা করে রোপণ করতে হবে।
সারের পরিমাণ ও প্রয়োগঃ
বিঘা প্রতি ২০-২৪ কেজি ইউরিয়া, ১৫-১৬ কেজি টিএসপি, ০৭-১০ কেজি এমওপি, ৭-৮ কেজি জিপসাম, ২০০-৫০০ গ্রাম দস্তা দরকার হবে। ইউরিয়া ছাড়া সকল সার শেষ চাষের সময় জমিতে প্রয়োগ করতে হবে। ইউরিয়া সার সমান তিন ভাগ করে, চারা রোপণের ৭-১০, ২০-২৫, ৩৫-৪০ দিন পর পর তিন কিস্তিতে উপরি প্রয়োগ করতে হবে।
জমির আগাছা দমনঃ
জমি খুব ভালোভাবে প্রস্তত করে চারা রোপণ করলে আগাছা কম হয়। জমিতে সবসময় পানি থাকলে আগাছা খুবই কম হয়। চারা রোপণের পর আগাছা দেখা দিলে নিড়ানি হাতের সাহায্যে আগাছা পরিষ্কার ও মাটি নরম করতে হবে। সারি করে চারা রোপণ করলে নিড়ানি যন্ত্রের সাহায্যে একই সাথে আগাছা পরিষ্কার ও মাটি নরম করা সম্ভব হয়। চারা রোপণের পর ১০-১৫ দিন অন্তর অন্তর ৩-৪ বার আগাছা পরিষ্কার ও মাটি নরম করা দরকার।
জমিতে সেচ প্রয়োগঃ
আমন ধান আবাদ করতে সেচের তেমন দরকার করা হয় না। তবে জমিতে পানির খুব অভাব হলে ধান থোড় আসার সময় সেচ দিয়ে জমিতে পানি নিশ্চিত করতে হবে। আবার ধান পাকার ১০-১২ দিন আগে জমির পানি শুকিয়ে ফেলতে হবে।
জমির রোগবালাই দমনঃ
ধানের দু’টি প্রধান রোগ হলো- খোল পোড়া বা সিথ ব্লাইট ও ব্লাস্ট রোগ।
এ রোগ দু’টি দমন করতে হলে-
১) রোগমুক্ত বীজ ব্যবহার করতে হবে,
২) ফসল কাটার পর নাড়া পুড়িয়ে ফেলতে হবে
৩) পর্যায়ক্রমে বিভিন্ন ফসলের চাষ করতে হবে,
৪) সুসম মাত্রায় সার ব্যবহার করতে হবে
৫) আক্রান্ত জমিতে ইউরিয়া উপরি প্রয়োগ করা বন্ধ করতে হবে
৬) অনুমোদিত বালাইনাশক উপযুক্ত মাত্রায় প্রয়োগ করতে হবে
জমির পোকামাকড় দমনঃ
ধানের প্রধান শত্রু হল মাজরা পোকা, পাতা শোষক পোকা, সবুজ পাতা ফড়িং, বাদামী গাছ ফড়িং, গল মাছি। ধান ক্ষেতে পোকা দেখা গেলেই কীটনাশক প্রয়োগ করা উচিৎ নয়। কারণ জমিতে ক্ষতিকর পোকার সাথে অনেক উপকারী পোকাও থাকে। তাই যে সমস্ত ব্যবস্থা নেয়া যেতে পারে তা হলো-
আলোর ফাঁদের সাহায্যে মথ দমন
- ডিমের গাদা সংগ্রহ ধ্বংস করা
- জমিতে ডালপালা পুঁতে পাখির সাহায্যে পোকা দমন করা
- ক্ষেতের পানি সরিয়ে শুকিয়ে বাদামী গাছ ফড়িং দমন করা
- ফাঁদ পেতে, গর্তে বিষটোপ দিয়ে ইদুঁর দমন করা
- ফসল কাটার পর নাড়া পুড়িয়ে ফেলতে হবে
- ইউরিয়া তিন কিস্তিতে উপরি প্রয়োগ করেও পোকা দমন করা যায়
এর পরও আক্রামণ ব্যাপক হলে পোকামাকড় দমনের জন্য অনুমোদিত কীটনাশক উপযুক্ত মাত্রায় প্রয়োগ করতে হবে।
ধানের জমির অবাঞ্চিত গাছ তুলে ফেলা (রোগিং)ঃ
যেমন- বিনাধান-৫ এর জমির কাংখিত ধান ফসলের জাত বিনাধান-৫ জাতের গাছ রেখে অন্য জাতের গাছ তুলে ফেলাকে অবাঞ্চিত গাছ তুলে ফেলা বা রোগিং বলে।
ধানের জমির অবাঞ্চিত গাছ তুলে ফেলার (রোগিং) প্রয়োজনীয়তাঃ
বীজের বিশুদ্ধতা বজায় থাকে, মানসম্মত বীজ উৎপাদিত হয় এবং এতে ফলন অনেক বেড়ে যায়।
কখন এ ধান কর্তন করতে হবেঃ
জুলাই মাসের শেষ সপ্তাহে রোপন করলে অক্টোবর মাসের মাঝামাঝি থেকে শেষ সপ্তাহের মধ্যে এ ধান কাটা যাবে। বিগত ২০০৮ ও ২০০৯ সনে বৃহত্তর রংপুর এলাকায় এ জাত আবাদ করে দেখা গেছে যে, যখন এ জাতের ধান পেকে যায় তখন আশে পাশের ধান কাঁচা থাকে। তাই এ এলাকার মঙ্গা নিরসনে বিনাধান-৭ আবাদ খুবই সহায়ক।
বীজ সংরক্ষণ কৌশলঃ
ফসল কাটার পর বীজ রাখতে হলে ৩-৪ দিন ভালভাবে রোদে শুকিয়ে কয়েকদিন ঠান্ডা স্থানে রাখতে হবে। পরে আবার ৩-৪ দিন রোদে শুকিয়ে ঠান্ডা করে উপযুক্ত পাত্রে ও যথাযথ স্থানে সংরক্ষণ করতে হবে। রক্ষিত বীজ বীজতলায় ফেলার আগে আরো ১-২ দিন রোদে দেয়া ভাল। সঠিকভাবে বীজ না শুকালে এবং বীজতলায় বীজ ফেলার পূর্বে ভালো করে না ভেজালে অংকুরোদগমে সমস্যা হতে পারে।
গত কয়েক বছর যাবত কৃষক পর্যায়ে উপযুক্ত ধানের বীজ সংরক্ষণ প্রযুক্তির উপর গবেষণা করা হয়েছে। গবেষণায় দেখা যায় যে, ধান ভাল ভাবে শুকিয়ে নিয়ে (১২% থেকে ১৪% আর্দ্রতায়) টিন, প্লাটিক অথবা মাটির তৈরী মটকার উভয় পার্শ্বে এনামেল পেইন্ট দিয়ে ভাল ও সুস্থ ধানের বীজ ৬-৮ মাস সংরক্ষণ করা যায়। এতে অংকুরোদ্গম ক্ষমতা প্রায় ৯০% থাকে। উল্লেখ্য যে, বীজ সংরক্ষণের পাত্রটি বায়ু নিরোধক অবস্থায় রাখা প্রয়োজন এবং পাত্রটিতে বীজ রাখার পর ফাঁকা স্থান অন্য কিছু দিয়ে ভরে রাখা প্রয়োজন। এতে করে পোকা মাকড়ের প্রজনন বৃদ্ধি ও আক্রমণ থেকে বীজকে রক্ষা করা যাবে। তাছাড়া নিম পাতা শুকিয়ে অথবা নিম তৈল বীজের সাথে মিশিয়েও বীজ সংরক্ষণ করা যায়।
তথ্যসূত্র ও কৃতজ্ঞতাঃ বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট, ময়মনসিংহ