বিএফআরআই গবেষণায় সাফল্য – ঝিনুক চাষে মাত্র পাঁচ মাসে মুক্তা – প্রতি একরে ৪০ লাখ টাকা আয় – সুযোগ হবে ২০ থেকে ৩০ লাখ লোকের কর্মসংস্থানের

[আরিফুল ইসলাম, বাকৃবি সংবাদদাতা]

Agri.Varsity  Mymensingh Pearl Culture Pic-3মুক্তা সৌখিনতা ও আভিজাত্যের প্রতীক। মুক্তা অলংকারে শোভিত অতি মূল্যবান রত্ন। মুক্তার প্রধান ব্যবহার অলংকার হলেও কিছু কিছু জটিল রোগের চিকিৎসায় এবং ঔষধ তৈরিতে মুক্তা ও মুক্তাচূর্ণ ব্যবহার হয়। এছাড়া মুক্তা উৎপাদনকারী ঝিনুকের খোলস নানা ধরণের অলংকার ও সৌখিন দ্রব্যাদি তৈরি এবং ক্যালসিয়ামের একটি প্রধান উৎস-যা হাঁস-মুরগী, মাছ ও চিংড়ির খাদ্যের একটি প্রয়োজনীয় উপাদান। প্রাচীনকাল থেকেই দেশের সব জায়গায় কম-বেশি মিঠাপানির ঝিনুক থেকে মুক্তা সংগ্রহের প্রক্রিয়া চলছে। বঙ্গোপসাগর প্রাকৃতিক মুক্তার আবাসস্থল। বাংলাদেশের মহেশখালী ছিল ‘পিংক পার্ল’ বা গোলাপী মুক্তার জন্য জগদ্বিখ্যাত। বাংলাদেশে ছড়িয়ে রয়েছে অসংখ্য পুকুর-দীঘি, খাল-বিল, হাওর-বাঁওড়। এসব জলাশয় মুক্তা বহনকারী ঝিনুকে পরিপূর্ণ। তবে গুণগত উৎকর্ষতা সম্পন্ন গোলাপী মুক্তা বৃহত্তর ঢাকা, মুন্সীগঞ্জ, ময়মনসিংহ, টাঙ্গাইল, কিশোরগঞ্জ, সিলেট, রাজশাহী, বগুড়া, ফরিদপুর ও চট্টগ্রামে বেশি পাওয়া যায়।
দেশের পুকুর-দীঘি, খাল-বিল, হাওর-বাঁওড়, নদী-নালা ও জলাশয়ে মাছের সাথে ঝিনুকে মুক্তা চাষ করে প্রতি একরে ৪০লাখ টাকা অতিরিক্ত আয় করা সম্ভব বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ মাৎস্য গবেষণা ইন্সটিটিউটের (বিএফআরআই) বিজ্ঞানীরা। ইতোমধ্যে তারা ময়মনসিংহের স্বাদুপানি কেন্দ্রের পুকুরে স্বল্পসময়ে মিঠাপানির ঝিনুক থেকে মুক্তা উৎপাদনে প্রাথমিক সাফল্য অর্জন করেছেন। গবেষণাকালে কৃত্রিম উপায়ে ঝিনুকে পাঁচ মাসে দুই থেকে তিন মিলিমিটার আকারের মুক্তা উৎপাদন করা সম্ভব হয়েছে। এর আগে একই আকারের মুক্তা উৎপাদন করতে সময় লেগেছিল দেড় থেকে দুই বছর। স্বল্পসময়ে ঝিনুকে মুক্তা উৎপাদন প্রযুক্তি মাঠপর্যায়ে সম্প্রসারণের মাধ্যমে বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদিত মুক্তা বিদেশে রফতানি করে প্রতি বছর ১৫০০ কোটি টাকা বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা সম্ভব। একই সাথে এতে ২০ থেকে ৩০ লাখ লোকের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে।
বিএফআরআই ১৯৯৯-০১ সালে ময়মনসিংহের স্বাদু পানি গবেষণা কেন্দ্রে প্রথম গবেষণায় ২-৩ মিলিমিটার সাইজের মুক্তা তৈরিতে সময় লেগেছিল দেড় থেকে দুই বছর। এরপর অর্থাভাবে মুক্তা গবেষণা কার্যক্রম বন্ধ হলেও গতবছর আবার তা শুরু হয়। মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের অধীনে ২০১০-১১ অর্থবছরে একটি ‘কোর’ গবেষণা প্রকল্প হাতে নেয়া হয়। ওই প্রকল্পের অধীনে গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে ঝিনুকে মেন্টাল টিস্যু ঢুকিয়ে অপোকৃত কম গভীরতার পুকুরে ছেড়ে দেয়া হয় এবং নিয়মিত পরিচর্যা করা হয়। এতে পাঁচ মাসেই ঝিনুকে দুই থেকে তিন মিলিমিটার আকারের মুক্তা জন্মে, যা ‘রাইস পার্ল’ নামে পরিচিত। বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন, বছরব্যাপী চাষ করা হলে মুক্তার আকার আরো বড় করা সম্ভব হবে। গ্রামীণ যেকোনো পরিবেশে বাড়ির আঙিনায় ছোট-বড় পুকুরে মাছের সাথে অতিরিক্ত ফসল হিসেবে মুক্তা চাষ করা সম্ভব বলে প্রকল্পের প্রধান গবেষক ড. মোহসেনা বেগম তনু জানান। গবেষণার ফলাফলে দেখা গেছে, একটি ঝিনুকে ১০ থেকে ১২টি মুক্তা জন্মে। প্রতিটি মুক্তার খুচরামূল্য ৫০ টাকা। প্রতি শতাংশে ৬০ থেকে ১০০টি ঝিনুক চাষ করা যায়। এক হিসাবে দেখা যায়, প্রতি শতাংশে ৮০টি ঝিনুকে গড়ে ১০টি করে ৮০০ মুক্তা পাওয়া যায়, যার বাজারমূল্য ৪০ হাজার টাকা। সেই হিসাবে প্রতি একরে ৪০ লাখ টাকার মুক্তা উৎপাদন করা সম্ভব । এছাড়াও মুক্তা উৎপাদনকারী ঝিনুকের মাংস মাছ ও চিংড়ির উপাদেয় খাদ্য হিসাবেও ব্যবহৃত হয়। অনেক দেশে ঝিনুকের মাংস মানুষের খাদ্য হিসাবে খেয়ে থাকেন। অর্থাৎ একজন চাষী মুক্তাচাষ করে মুক্তার পাশাপাশি ঝিনুকের খোলস ও মাংসল অংশ বিক্রি করেও লাভবান হতে পারেন। আন্তর্জাতিক বাজারে মুক্তার চাহিদা যেমন দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে, তেমনিভাবে অভ্যন্তরীণ বাজারেও মুক্তার চাহিদা উলেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। তাছাড়া মুক্তা উৎপাদনের জন্য চাষকৃত ঝিনুক ছাঁকন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে জলাশয়ের পরিবেশ উন্নত করে। উপযুক্ত পৃষ্ঠপোষকতা পাওয়া গেলে দেশে মুক্তাচাষে বিরাট সফলতা অর্জন করা সম্ভব-যা দেশের ব্যাপক জনগোষ্ঠির কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করে দেবে।


আরিফুল ইসলাম
বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় সংবাদদাতা, ময়মনসিংহ।
মোবাইলঃ ০১৭৩৭ ৫১২৯১৭

Leave a Comment

You must be logged in to post a comment.