পাবদা ও গুলশা মাছের চাষ ব্যবস্থাপনা

পাবদা ও গুলশা মাছ বাংলাদেশের ছোট মাছগুলোর মধ্যে অন্যতম। মিঠাপানির এ মাছ দু’টি নদী-নালা, খাল-বিল, হাওর-বাঁওড়ে একসময় প্রচুর পরিমাণে পাওয়া যেত। কিন্তু বর্তমানে প্রাকৃতিক পরিবেশ বিপর্যয়ের কারণে প্রজনন মাত্রা ও বংশবৃদ্ধি ব্যাহত হওয়ায় এ মাছের প্রাচুর্যতা অনেক কমে গেছে। অত্যন্ত সুস্বাদু ও অত্যাধিক বাজার মূল্যের কারণে পাবদা ও গুলশা মাছ মৎস্যচাষীসহ সংশ্লিষ্ট সকলের দৃষ্টি আকৃষ্ট হয়েছে। ইতোমধ্যে কৃত্রিম প্রজননের মাধ্যমে এদের পোনা উৎপাদন শুরু হয়েছে এবং স্বল্প পরিসরে চাষ কার্যক্রম বাস্তবায়িত হচ্ছে।

রুইজাতীয় মাছের সাথে পাবদা ও গুলশার মিশ্র চাষ
চাষের সুবিধাঃ

  • মৌসুমী পুকুর, বার্ষিক পুকুর ও অন্যান্য জলাশয়ে এ মাছ চাষ করা যায়।
  • এ মাছ চাষে পুকুরের সব স্তরের খাবারের ব্যবহার নিশ্চিত হয়।
  • ৫-৬ মাসের মধ্যেই কয়েক ধরণের রুইজাতীয় মাছের পাশাপাশি পাবদা ও গুলশা মাছ বাজারজাত করা যায়।
  • শুধু রুইজাতীয় মাছ চাষের চেয়ে অধিক মুনাফা পাওয়া যায়।
  • পাবদা ও গুলশা মাছ সুস্বাদু, তাই বাজার মূল্য অনেক বেশি।

চাষ পদ্ধতিঃ
পুকুর প্রস্তুতিঃ

  • শুকনো মৌসুমে পুকুর থেকে জলজ আগাছা পরিষ্কার ও পাড় মেরামত করতে হবে।
  • ছোট মাছ চাষের ক্ষেত্রে পুকুর শুকানো উচিত নয়। তাই বার বার ঘন ফাঁসের জাল টেনা রাুসে মাছ ও তিকর প্রাণি অপসারণ করতে হবে।
  • প্রতি শতকে ১-২ কেজি পাথুরে চুন প্রয়োগ করতে হবে। মাটির গুণাগুণের ওপর ভিত্তি করে চুনের মাত্রা কম-বেশি হয়ে থাকে।
  • পুকুরে পর্যাপ্ত পরিমাণ মাছের প্রাকৃতিক খাদ্য জন্মানোর জন্য পোনা ছাড়ার পূর্বে সার প্রয়োগ করতে হবে। প্রতি শতকে ৪-৬ কেজি গোবর, ১০০ গ্রাম ইউরিয়া ও ১০০ গ্রাম টিএসপি প্রয়োগ করা ভালো।
  • পানির রং সবুজ/বাদামী সবুজ হলে পোনা ছাড়ার উপযুক্ত হয়।

পোনা মজুদঃ

  • পুকুরে মাছ চাষের সফলতা নির্ভর করে ভালো জাতের সুস্থ, সবল ও সঠিক প্রজাতির পোনা সঠিক সংখ্যায় মজুদের ওপর।
  • পুকুরে পোনা ছাড়ার আগে পরিবহনকৃত পোনা পুকুরের পানির তাপমাত্রার সাথে খাপখাইয়ে নিয়ে ১০ লিটার পানি ও ১ চামচ (৫ গ্রাম) পটাসিয়াম পারম্যাংগানেট অথবা ১০০ গ্রাম লবণ মিশিয়ে দ্রবণ তৈরী করে তাতে ১-২ মিনিট গোসল করিয়ে পোনা জীবাণুমুক্ত করতে হবে।
  • নিম্নের ছকে বর্ণিত যে কোন একটি নমুনা অনুযায়ী ১০-১২ সেমি. আকারের রুইজাতীয় মাছ ও ৫-৭ সেমি. আকারের পাবদা বা গুলশা মাছের সুস্থ সবল পোনা মজুদ করতে হবে।

কার্প-পাবদা মডেল – ১
মাছের প্রজাতি    সংখ্যা
কাতলা                 ১২
রুই                      ৮
মৃগেল                  ৮
গ্রাসকার্প              ২
পাবদা                 ৭০
মোট                   ১০০

কার্প-পাবদা মডেল – ২
মাছের প্রজাতি    সংখ্যা
সিলভার কার্প       ৮
কাতলা                 ৪
মৃগেল                  ৮
গ্রাসকার্প              ২
সরপুটি                ৮
পাবদা                ৭০
মোট                  ১০০

কার্প-পাবদা-গুলশা মডেল
মাছের প্রজাতি    সংখ্যা
কাতলা                 ৮
রুই                     ১০
মৃগেল                 ১০
গ্রাসকার্প              ২
পাবদা                 ৫০
গুলশা                 ৫০
মোট                 ১৩০

মজুদ পরবর্তী পরিচর্যাঃ

  • পুকুরে পর্যাপ্ত পরিমাণ প্রাকৃতিক খাদ্য রাখার জন্য দৈনিক বা ৭ দিন পর পর নিয়মিত সার প্রয়োগ করতে হয়।
  • সাধারণ নিয়ম অনুসারে দৈনিক শতক প্রতি ১৫০ গ্রাম গোবর অথবা ৩০০ গ্রাম কম্পোস্ট, ৫ গ্রাম ইউরিয়া ও ৫ গ্রাম টিএসপি একটি পাত্রে পানির সাথে ১ দিন ভিজিয়ে রেখে পরদিন সকাল ১০-১১টায় পুকুরে ছিটিয়ে দিতে হবে।
  • অথবা ৭ দিন/১০ দিন পর পর সার ব্যবহার করতে হলে উপরোক্ত পরিমাণে দিনের গুণিতক হারে সার প্রয়োগ করতে হবে। তবে প্রতিদিন সার ব্যবহার করাই সর্বোৎকৃষ্ট।
  • জৈব ও রাসায়নিক সার মিশিয়ে পরিমাণ মত ও নিয়মিত ব্যবহার করলে বেশি উৎপাদন পাওয়া যায়।

সম্পুরক খাদ্য সরবরাহঃ
কার্প-পাবদা-গুলশার মিশ্র চাষে সম্পূরক খাবার হিসাবে ব্যবহৃত খাদ্যোপাদানের পরিমাণ নিম্নে বর্ণিত হলো-

খাদ্যোপাদান    মিশ্রণের হার (শতকরা)
চালের মিহি কুড়া    ৪০%
গমের ভুসি             ২০%
সরিষার খৈল          ২০%
ফিশমিল                ২০%
মোট                     ১০০%

  • ১০-১২ ঘন্টা ভিজানো সরিষার খৈলের সাথে শুকনো গমের ভুসি বা চালের মিহি কুঁড়া মিশিয়ে গোলাকার বল তৈরি করতে হবে।
  • পুকুরে মজুদকৃত মাছের মোট ওজনের শতকরা ৫-৩ ভাগ হারে দৈনিক খাবার দিতে হবে।
  • শীতকালে খাবারের পরিমাণ শতকরা ১-২ ভাগ হারে সরবরাহ করতে হবে।
  • বরাদ্দকৃত খাবার দিনে ২ বার প্রয়োগ করা ভাল।
  • মাসিক নমুনায়নের মাধ্যমে খাবারের পরিমাণ নির্ধারণ করতে হবে।
  • এছাড়াও প্রতিষ্ঠিত কোম্পানীর বাণিজ্যিক পিলেট খাবারও মাছকে সরবরাহ করা যেতে পারে।

 

সতর্কতা
পুকুরের তলদেশে কাদা থাকলে তিকর গ্যাস জমে থাকতে পারে। দড়ির সাথে লোহা বা মাটির কাঠি কিংবা ইট বেঁধে হররা তৈরি করে পুকুরের তল ঘেষে আস্তে আস্তে টেনে তলার গ্যাস বের করে দিতে হবে।
প্রতি মাসে একবার কিছু মাছ ধরে মাছের স্বাস্থ্য পরীা করতে হবে।
নিয়মিত খাদ্য সরবরাহ করতে হবে।
পুকুরে পানি কমে গেলে পানি সরবরাহ করতে হবে।
পানি বেশি সবুজ হয়ে গেলে সার প্রয়োগ বন্ধ রাখতে হবে।

আহরণঃ
আংশিক আহরণঃ
রুইজাতীয় সব মাছ ও পাবদা-গুলশা মাছের বৃদ্ধির হার সমান নয়। বেশি লাভের জন্য বড় মাছ আহরণ করে ছোট মাছগুলোকে বড় হওয়ার সুযোগ করে দেয়া উচিত। তাই রুইজাতীয় যে মাছগুলো ৫০০-৭০০ গ্রামের উপরে হবে তা আহরণ করে সমসংখ্যক পোনা ছাড়তে হয়।
চুড়ান্ত আহরণঃ
বছর শেষে সব মাছ আহরণ করে ফেলতে হবে। বাজার দর এবং পরবর্তী ফসলের জন্য পোনা প্রাপ্তির ওপর নির্ভর করে চুড়ান্ত আহরণের সময়কাল ঠিক করতে হবে।
পাবদা ও গুলশা মাছ ৮-৯ মাস চাষে যথাক্রমে ২৫-৩০ গ্রাম ও ৪৫-৫০ গ্রাম ওজনের হয় এবং তা বিক্রয়ের জন্য উপযুক্ত হয়।

সম্ভাব্য আয় ব্যয়ঃ
৩০ শতক পুকুরে কার্প-পাবদা-গুলশা মিশ্র চাষের আয়-ব্যয় ও উৎপাদনের হিসাব নিচে দেখানো হলো।
মোট ব্যয়        = ৩৯,১৮০.০০
মোট উৎপাদন  = ৭৫৫ কেজি;    বিক্রয়মূল্য = ৫৫,৭৫০.০০
মুনাফাঃ মোট ব্যয় – মোট আয় = ৫৫,৭৫০.০০ – ৩৯,১৮০.০০ = ১৬,৫৭০.০০ টাকা

Leave a Comment

You must be logged in to post a comment.